কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ২০-২২)

(পর্ব ২০) আগের পর্বগুলোতে সুরা ফাতিহার আলোচনায় জেনেছি, কিভাবে বিশেষতঃ এই সুরাটির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সাথে কথোপকথন করতে পারি, এবং আল্লাহ প্রতিটি আয়াতের সাথে সাথে কিভাবে জবাব দেন। এই সুরা আল্লাহর রুবুবিয়াতের (আল্লাহই সমস্ত সৃষ্টি জগতসমূহের রব) ঘোষণা দেয়, সাথে সাথে এটাও বর্ণনা করে যে আল্লাহর রুবুবিয়াতে রয়েছে তাঁর রহমত ও করুনার প্রাধান্য, যে কারনে সৃষ্টি জগতসমূহের রবের প্রশংসার পর পরই আমরা বলি –‘আর রহমানির রহীম’। কিয়ামত দিবসের মালিকত্বের বর্ণনার আগেই আমরা জানতে পারি যে তাঁর করুনা তাঁর ক্রোধের চেয়ে বেশী। অতঃপর আমরা জানতে পারি কেন আমাদেরকে এই করুনা করা হয় – যাতে আমরা শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করি। এবং তাঁর ইবাদত করতেও আমরা তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। একারনে আমরা বলি – إِيّاكَ نَعبُدُ وَإِيّاكَ نَستَعينُ “শুধুমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি” কাজেই আমরা যদি সাহায্য পেতে চাই, আমাদেরকে সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। পথপ্রদর্শন এখন আমরা প্রকৃতপক্ষে দোয়া শুরু করছি। اهدِنَا الصِّرٰطَ المُستَقيمَ ﴿٦﴾ صِرٰطَ الَّذينَ أَنعَمتَ عَلَيهِم غَيرِ المَغضوبِ عَلَيهِم وَلَا الضّالّينَ ﴿٧ “আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন; তাদের নয় যাদের প্রতি আপনার গজব বর্ষিত হয়েছে এবং তাদেরও নয় যারা পথভ্রষ্ট।” (সুরা ফাতিহাঃ৬-৭) ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, সুরা ফাতিহার এই দোয়াটিই হল সর্বশ্রেষ্ঠ, বিজ্ঞতম, এবং সবচেয়ে উপকারী দোয়া। আল্লাহ যদি আমাদের সরলতম পথ প্রদর্শন করেন, তিনি আমাদের তাঁর ইবাদত করতেও সাহায্য করেন। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, ‘আমি যদি সঠিক পথেই থাকি তবে আবার কেন পথপ্রদর্শনের জন্য প্রার্থনা করব? আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, কুরআন তেলাওয়াত করি- আল্লাহ তো নিশ্চয়ই আমাকে হেদায়াত করেছেনই।’ প্রথমত, হেদায়াতের সর্বোচ্চ পর্যায় হল মহানবী (সাঃ) এর সমান পর্যায়ে পৌছতে পারা, অথচ আমরা কেউই এমনকি সাহাবীদের পর্যায় পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হয়েছি বলেও দাবী করতে পারি...

কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ১৫-১৯)

(পর্ব ১৫) আল্লাহ্‌র নামে আমরা এখন নামাজে একটি সুন্দর জায়গায় এসে পৌঁছেছি, আমরা সবচেয়ে সুন্দর নামটি উচ্চারণ করি – বিসমিল্লাহ। এই রাজসিক নামের উচ্চারণ আমাদের অন্তরে শান্তি আনে, সমস্ত জায়গা ও সব সময় নিরাপত্তার অনুভূতি দেয় – এই নামের স্মরণ ছাড়া আত্মা কি শান্তি পায়? কোন মুসলিমের অন্তরে অবস্থিত তাঁর এই নামটিই সবচেয়ে অসাধারণ বিস্ময়কর ব্যাপার, কারন এমন কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস নেই যা এই নামের বরকতে বৃদ্ধি না পায়, আবার এমন কোন বড় জিনিষ নেই যা এই নামের বরকতে অনুগ্রহ না পায়। এই নামটি এতই চমকপ্রদ, এটি যেকোনো জায়গার, যে কোন সময়ের ক্ষতি থেকে নিরাপত্তা দেয়। মহানবী (সাঃ) বলেছেন- কেউ যখন কোন স্থানে বিশ্রামের জন্য অবতরণ করে সে যেন বলে, আউযু বিকালিমা তিল্লা হিততা-ম্মা-তি মিন শাররি মা খালাক (আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমা সমূহের মাধ্যমে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি, তাঁর সৃষ্ট বস্তুর সমুদয় অনিষ্ট হতে), কোন কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আবার তার বাহনে আরোহণ করে।(মুয়াত্তা ৫৪/১৩৩৪) এই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাওয়াতায়ালা আপনাকে হেফাজত করবেন, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, ইনশাল্লাহ। আর সকল সময়ের নিরাপত্তার জন্য মহানবী (সাঃ) বলেছেন- بِسمِ اللهِ الذي لا يَضُرُّ مَعَ اسمِهِ شَيءٌ في الأرْضِ وَلا في السّماءِ وَهوَ السّميعُ العَليم” من قالها ثلاثاً إذا أصبح وثلاثاً إذا أمسى لم يضره شيء ‘বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়া দুররু মা’আসমিহি শাইআন ফিল আরদি ওয়া লা ফিস সামা-ই ওয়াহুয়াস সামিউল আলীম’ (আমি সেই আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি, যার নামে শুরু করলে আকাশ ও পৃথিবীর কোন বস্তুই কোনরূপ অনিষ্ট সাধন করতে পারে না। বস্তুত তিনি হচ্ছেন সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা)যে এই দোয়া সকালে তিনবার ও সন্ধ্যায় তিন বার বলবে, কোন কিছু তার ক্ষতি করতে পারবে না। (আবু দাউদ ৪১/৫০৬৯) ইবনে আল কাইয়িম বলেন, শুধুমাত্র নামের মহত্ত্বই যদি এমন...

কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ৮-১৪)

(পর্ব ৮) নামাজের পূর্বেই নামাজের অবস্থায়: যখন আমরা “সালাত”এর কথা বলে থাকি, আমরা সবাই মনে করি যে এটা আসলে শুরু হয় যখন আমরা দাঁড়িয়ে হাত তুলি এবং বলি “আল্লাহ আকবার”| কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়, এটা “আল্লাহ আকবার” বলারও আগে থেকে শুরু হয়| নবী(সা:) বলেন: لا زال أحدكم في صلاة ما انتظر الصلاة “একজন যতক্ষণ নামাজের জন্যে অপেক্ষায় থাকে, তার জন্যে ঐ সম্পূর্ণ সময় নামাজের মধ্যে ধরা হয়|”(বুখারী, মুসলিম) পুরুষদের জন্যে, এটা সেই সময় থেকে শুরু হয় যখন সে নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে মসজিদে জামাতের সাথে নামাজের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে| যারা মসজিদে অবস্থান করছেন না এমন মহিলাদের জন্য এই নামাজের সময় শুরু হয় যখন তিনি অজু করে নামাজের জন্য সঠিক পোশাক(যদি তাঁর দরকার হয়) পরে নামাজের সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন তখন থেকে| একটি গুপ্তধন: শয়তান নামাজকে ঘৃনা করে| নবী(সা:) বলেন, “যখন আজানের শব্দ উচ্চারিত হয়, শয়তান তখন সশব্দে বায়ু ছাড়তে ছাড়তে দৌড়ে পালিয়ে যায় যাতে তার কানে আর আজানের শব্দ না আসে| আজান শেষ হলে আবার ফিরে আসে; ইকামাতের সময় আবার সে পালিয়ে যায় এবং শেষ হলে আবার ফিরে আসে, এবং মানুষের মনকে ফিসফিসিয়ে ধোঁকা দিতে থাকে(যাতে নামাজ থেকে মনোযোগ সরে যায়) এবং মানুষকে এমন সব জিনিস মনে করিয়ে দেয় যা নামাজের পূর্বে তার মাথায় ছিলনা এবং যার কারণে মানুষ ভুলে যায় যে সে কতো রাকাত নামাজ পরেছে|” [বুখারী] নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ন দিক যেটাকে আমরা আমলেই নেই না সেটা হল আজান| আমরা কি কখনো আজানের সুমধুর সুর-মূর্ছনা অনুভব করেছি? যে আজানের মাধুর্য আস্বাদন করে তার নামাজের খুশু বৃদ্ধি পায়| প্রশ্ন আসতে পারে যে খুশুর সাথে আজানের সম্পর্ক কি? আজানের সময় হতেই শয়তান মানুষের মনকে অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতে থাকে, যাতে আজানের গুনাবলী থেকে সে কোন লাভ না...

কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ১-৭)

(পর্ব ১) পরম করুনাময় এবং অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে সকল প্রশংসা ও শুকরিয়া আল্লাহ তায়ালার জন্যে, এবং অজস্র দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক সকল নবী রাসুল গনের উপর| বেশ কিছুদিন আগে, কুয়েতী দা’য়ী মিশারী আল-খারাজ এর উপস্থাপনায় ”كيف تتلذذ بالصلاة؟” নামে একটি আরবি প্রোগ্রাম প্রচারিত হয়েছিল যার মানে হলো: “কিভাবে নামাজের মধুরতা আস্বাদন করা যায়?” আমা…দের প্রায় সবারই নামাজের ‘খুশু’ কমবেশি হয়ে থাকে| খুশু কী? এটা আসলে অন্তরের বা মনের একটি অবস্থা যা নামাজে প্রশান্তি, গাম্ভীর্য ও বিনম্রতা বজায় রাখে; যা হৃদয় থেকে বর্ষিত হয়ে আমাদের আল্লাহর সামনে বিনম্র ও আম্ত্মসমর্পিত করে| কোন কোন সময় নামাজে আমাদের আরাধনা এমন হয় যেনো আমরা প্রতিটা শব্দ কে ভেতর থেকে অনুভব করি; আবার অন্য সময় নামাজ শুধু নিয়ম মেনে উঠাবসা ছাড়া আর কিছুই হয় না| ইনশা-আল্লাহ, আমরা আগামী কিছুদিন নামাজের অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করব| এক আনসারী ও এক মুহাজির এর কাহিনী: সুনানে আবু দাউদ থেকে হাসান সনদে বর্ণিত; কোন একটি যুদ্ধের সময় নবী(সা:) দুজন পাহারাদার নিয়োগ করেন, তাদের একজন ছিলেন মুহাজিরীন, আরেকজন ছিলেন আনসার| একটা সময় আনসারী সাহাবী নামাজের জন্য উঠে পড়লেন অপরদিকে মুহাজিরীন সাহাবী তখন ক্লান্তিতে তন্দ্রা মতো এসেছিলেন| এই সময় প্রতিপক্ষের এক মুশরিক এই অবস্থা দেখে সুযোগ বুঝে আনসার সাহাবীর দিকে তীর ছুড়ে মারেন| এটা তাঁর গায়ে লাগে, কিন্তু তবুও কষ্ট করে তীর বের করে রক্তাক্ত অবস্থায় নামাজ চালিয়ে গেলেন| এটা দেখে ঐ মুশরিক আবার তীর নিক্ষেপ করলেন| আবারও আনসার সাহাবী তীরটি অপসারণ করে নামাজ চালিয়ে গেলেন| কিন্তু যখন তৃতীয় তীর আঘাত হানল; তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না এবং তিনি রুকু এবং সেজদায় চলে গেলেন, এর মাঝে মুহাজিরীন সাহাবীর ঘুম ভেঙ্গে যায়(মুশরিক তা দেখে পালিয়ে যায়), এবং তাঁর সাথীর রক্তাক্ত অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে উঠে বললেন “সুবহান-আল্লাহ!...

কীভাবে নামাজের মাধূর্য আস্বাদন করা যায় (পর্ব ২৪)

আমরা যখন কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করি, আমাদের খুশু থাকা উচিত কারণ আমরা আল্লাহর কালাম বা কথা পড়ছি। আমরা যখন সিজদায় যাই, আমরা জানি আল্লাহ আমাদের প্রার্থনার জবাব দেন, তাই আমরা বেশী মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করি। তাহলে রুকুতে আমাদের মনের কি অবস্থা থাকা উচিত? আত্মার চাহিদা পূরণ আমাদের সবারই কিছু প্রাত্যহিক চাহিদা আছে। একজন বাবা অপেক্ষায় থাকেন কখন কাজ থেকে ঘরে ফিরে শিশু সন্তানকে আলিঙ্গন করবেন, সন্তান যদি ঘুমিয়েও থাকে, বাবা অন্ততঃ একটি চুমু খান মনের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য। যখন আমরা খুব বেশী ক্ষুধার্ত থাকি, আমরা মাঝে মাঝে বেশী ক্লান্ত বা খিটখিটে হয়ে যাই যতক্ষণ পর্যন্ত না কিছু খেয়ে নেই। ঠিক যেমন আমাদের মনের ও শরীরের চাহিদা আছে, আমাদের আত্মারও কিছু চাহিদা আছে। সৃষ্টিকর্তার ইবাদতের জন্য আত্মা তৃষ্ণার্ত থাকে। অনেকেই বুকের ভেতর শূন্যতা অনুভব করেন, আর সেটাকে পূরণ করার জন্য অন্য কিছুর সন্ধান করেন। কিন্তু যেমন একজন ক্ষুধার্ত মানুষ দৌড়িয়ে তার ক্ষুধার চাহিদা মেটাতে পারে না- তা অবাস্তব; ঠিক তেমনি এই আত্মার তৃষ্ণাও সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য ছাড়া অন্য কিছুতে মেটানো সম্ভব না। রুকুর মাধ্যমে বিনম্রতা আত্মার বিনম্রতার মাধ্যমেই সত্যিকারের আনুগত্য সম্ভব, আর রুকু তারই একটি বহিঃপ্রকাশ। হাকিম বিন হিজাম নামক জনৈক আরব ইসলাম কবুল করার সময় রাসুল (সাঃ) কে বলেছিল যে, সে সমস্ত নির্দেশ পালন করবে শুধু নামাজের সময় রুকু করা ছাড়া, কারণ তাতে বিনীত হতে হয়। কাজেই আমরা যখন রুকুতে যাবো, আমরা সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখব যেন রুকু অবস্থায় আমাদের মেরুদণ্ড ঠিক মতো সোজা থাকে (মাটির সাথে সমান্তরাল), মাথা ঠিক মতো যথেষ্ট নোয়ানো থাকে, এবং “সুবহানা রব্বিআল ‘আযীম” (আমি আমার মহার প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি) কথাটির উচ্চারণ যেন আমাদের মনের গভীর বিশ্বাস থেকে হয়। যখন আমরা বলি “সুবহানা রব্বিআল ‘আযীম”, আমরা আল্লাহর সুবহানা ওয়াতা’আলার একত্ববাদও প্রকাশ করছি। ‘রব’ শব্দটি একাধিক অর্থ...