‘আলহামদুলিল্লাহ’ এর দার্শনিক দিক

  কুরআনের যুক্তি হলো, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সৌজন্যপ্রবণ। আদব, শিষ্টাচার বা শালীনতার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ঝোঁক রয়েছে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই ভালো। অনেক নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদীও এই বিষয়টা নিয়ে গর্ব করেন। তারা এভাবে বলবে – “আমার ভালো হতে ধর্মের দরকার নেই। আমি নিজে নিজেই ভালো থাকতে পারবো। আমার নৈতিক অনুভূতি রয়েছে। আমার বিবেক আছে।” তাহলে, বিবেকের ব্যাপারটি এমন ব্যক্তিও অস্বীকার করে না যে আধ্যাত্মিকতার সমগ্র আলোচনাকে অস্বীকার করে। যাদের একেবারে চরম অধঃপতন হয়নি তারা অন্তত নৈতিক কম্পাস থাকার কথা অস্বীকার করবে না। আর যারা একেবারে অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে তারা বলবে – “নৈতিকতা বলতে কিচ্ছু নেই, তোমার যা খুশি তাই করো। তুমি যা করো তাই সঠিক। যা করতে ভালো লাগে তাই ঠিক।” কেউ এমন পর্যায়ে পৌঁছলে তার এবং পশুর মাঝে আর কোনো পার্থক্য থাকে না। কারণ, পশু যাই করুক না কেন আপনি এর জন্য তাকে মন খারাপ করতে দেখবেন না। মুরগি খেয়ে ফেলার কারণে সিংহের মাঝে অপরাধবোধ জাগ্রত করতে পারবেন না। (অন্যের ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলার কারণে কোন ছাগলের ভেতরেও অনুশোচনা জাগাতে পারবেন না।) তাদের কোনো বিবেক নেই। আপনাকে কামড় দেওয়ার কারণে মশা এসে ক্ষমা চাইবে না। তাদের কর্মের ভালো বা মন্দ ফলাফলের কোনো জ্ঞান নেই। ধর্ম অস্বীকার করতে করতে যদি এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেন যেখানে নৈতিক কম্পাস থাকার কথা অস্বীকার করেন, তাহলে কংগ্রাচুলেশন! আপনি জাস্ট একটি জানোয়ারে পরিণত হলেন। কুরআনে এসেছে – “সুম্মা রদাদনাহু আসফালা সাফিলিন।” (তারপর আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি হীনদের হীনতম রূপে।) যাইহোক, স্বাভাবিক ক্ষেত্রে, প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সৌজন্যপ্রবণ। এই সৌজন্যের একটি অংশ হলো সমাদর করা, তারিফ করা। একজন ভদ্র মানুষ সুন্দর কিছু দেখলে তার কদর করে। একজন শিষ্টাচারী মানুষ বিমান থেকে চমৎকার কোন দৃশ্য দেখে বলে উঠে – ওয়াও! দৃশ্যটা খুবই সুন্দর। একজন শিষ্টাচারী মানুষ সুন্দর কোন চিত্র,...

আমাদের জবাব কেমন হওয়ার কথা?

যে কেউ গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়ন করেছে জানে যে আল্লাহ বিভিন্ন সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন কিভাবে নবী-রাসূলগণ অপমানিত হয়েছেন। কীভাবে তাদেরকে নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে। কীভাবে খুব কদর্য ভাবে তাদেরকে বর্জন করা হয়েছে। এবং কিভাবে নবী-রাসূলগণ অবিশ্বাসীদের বিদ্রুপের কষ্ট নিজের সহ্য করেছেন। নূহ (আ) অভিযোগ করেছেন কিভাবে মানুষ তাকে জঘণ্য ভেবেছে। এবং কিভাবে তারা তাদের কানে আঙ্গুল দিয়ে তাঁর থেকে দূরে সরে গিয়েছে এবং তাদের কাপড় টেনে ধরেছে তাঁর প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা প্রকাশ করতে। আমাদের রাসূল (স) ও এর ব্যতিক্রম নন। এই কুরআন যা আমাদের রাসূল (স) কে সম্মানিত করেছে, এখান থেকে আমরা এমন কিছু কষ্টদায়ক শব্দের কথাও জানতে পারি যা তাঁকে বলা হয়েছিল। ওসব রাসূল (স) কেও আওড়াতে হতো, স্মরণ করতে হতো যা তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, সাহির (যাদুকর), মাজনুন (পাগল), কাজ্জাব (পাকা মিথ্যেবাদী) আরো কত অপবাদ আমাদের রাসূলের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল এবং এর সবই কুরআনে আছে। আল্লাহ চান আমরা যেন এগুলো স্মরণে রাখি। এটা সত্যি যে, সব রাসূলগণ যদিও তাঁরা আল্লাহর সবচয়ে মহান সৃষ্টি এবং আল্লাহ নিজে তাদের সম্মানিত করেছেন পাশাপাশি তাঁরাই সবচয়ে কঠিন অপমান এবং বিদ্রুপের স্বীকার হয়েছেন। কিন্তু এর জবাব কেমন হওয়ার কথা? রাসূলুল্লাহ (স) এর অপমানে কারো যদি রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ার কথা আমার মতে সেটা হবার কথা রাসূলুল্লাহ (স) এর সাহাবীদের। যাদের বিশ্বাসের সাথে আমার আপনার কোন তুলনাই চলে না। কিন্তু কই উনারা তো ঐভাবে জবাব দেননি যেভাবে আমাদের কেউ কেউ দেয়। কই উনারা তো মিছিল করেননি। কই উনারা তো রাগে ক্ষোভে চিৎকার-চেঁচামেচি করেননি। কারণ, তারা জানেন, কুরআন শুধু রাসূলুল্লাহ (স) এর জন্য তাদের ভালোবাসা দিতে আসেনি বরং কীভাবে সেই ভালোবাসাটা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সেটাও শেখাতে এসেছে। এবং কীভাবে এইসব অপমানের জবাব দিতে হয় তাও শেখাতে এসেছে। কীভাবে আমরা এটা জানি না...

মোহরাংকিত অন্তরের লক্ষণসমূহ

— উস্তাদ নোমান আলী খান আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার সাত নম্বর আয়াতে বলেন – “আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব।” এখানে মোহর লাগানো অন্তর বলতে কোন অন্তরকে বুঝানো হয়েছে? অন্তর হলো ভালোবাসার জায়গা। আল্লাহ যখন কারো অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন, সিল মেরে দেন তখন সে অন্তর সেসব জিনিসকে ভালোবাসতে অপারগ হয়ে পড়ে যেগুলো তার ভালোবাসার কথা ছিল। যেসব বিষয় ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য তারা সেগুলো ঘৃণা করে। ঈমানদারদের ভালোবাসার কথা তাদের। কিন্তু তারা তাদের ঘৃণা করা শুরু করে। সত্যের প্রতি তাদের ভালোবাসা থাকার কথা, কিন্তু সত্যকে তারা ঘৃণা করা শুরু করে। ন্যায়কে তাদের ভালোবার কথা, কিন্তু ন্যায়কে তারা ঘৃণা করা শুরু করে। সুবহানাল্লাহ! অন্তর হলো দয়ার জায়গা। কিন্তু অন্তরে যখন মোহর মেরে দেয়া হয়, তখন ‘রাহমা’ হারিয়ে যায়। এই মানুষগুলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর কথা বলতে পারে, নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে কারণ তাদের অন্তর মোহরাংকিত। অন্তর হলো কৃতজ্ঞতার জায়গা। কৃতজ্ঞতা আসে অন্তর থেকে। যখন অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয় তখন এই মানুষগুলোর অন্তরে কৃতজ্ঞতার কোনো অনুভূতি আর জাগ্রত হয় না। তারা কাউকে কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়োজন বোধ করে না। তারা মনে করে তাদের তো সব এমনিতেই পাওয়ার কথা। অন্তর হলো ভয়ের জায়গা। যখন অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয় তখন তারা তাদের কর্মফলের কোন ভয় করে না। অন্তর হলো প্রত্যাশার জায়গা। এই মানুষগুলো হতাশ। পরকালের ব্যাপারে তাদের কোনো আশা নেই। অন্য কারো ভালোর প্রতিও তাদের কোনো আশা নেই। তারা নিজেদের জন্যেও উন্নতির কোনো আশা করে না। তারা মনে করে সবকিছুই অর্থহীন। মন যা চায় তাই করো, কারণ যাই করো না কেন জীবন তো দুর্বিষহ এমনিতেই। এটাই তাদের মানসিকতা। তারা আশাহীন মানুষ, কারণ তাদের অন্তর তালাবদ্ধ। অন্তর হলো অনুশোচনার জায়গা। যখন খারাপ...

নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাওয়া, ফিরে আসা

ক্ষমা চাওয়াটা দুইভাবে হয়ে থাকে। জিহ্বার মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়া এবং অন্তরের মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়া। মানুষ সাধারণত নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকে। আমি যদি কোনো কারণে আপনার সমালোচনা করি যেমন আমি কাউকে বললাম – ”এই যে, আমি আপনাকে অমুক কথা বলতে শুনেছি। আপনি কেন এটা বলেছেন?” সে তৎক্ষণাৎ হয়তো বলে উঠবে – ”আমি এমনটা বোঝাতে চাই নি, আপনি জানেন না আমি কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি! আপনি তো পুরো ঘটনাটাই জানেন না।” সুতরাং কেউ আপনাকে যদি বলে, ভাই আমি আপনাকে এটা এটা করতে দেখেছি। আপনি সাথে সাথে নিজের পক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করেন, আত্মরক্ষামূলক হয়ে উঠেন। بَلِ الْإِنسَانُ عَلَىٰ نَفْسِهِ بَصِيرَةٌ – وَلَوْ أَلْقَىٰ مَعَاذِيرَهُ – ﴾বরং মানুষ নিজেই তার নিজের কাজ সম্পর্কে নিজেই পূর্ণ অবগত। তবুও তারা প্রচুর অজুহাত দেখায়﴿ [সূরা কিয়ামাহঃ ১৪]। আপনি যদি আসলেই আল্লাহর ক্ষমা চান। আপনাকে নিরিবিলি একটা সময় খুঁজে নিতে হবে। যদি আরবীতে দো’আ করতে না পারেন কোনো সমস্যা নেই। আপনি শুধু পাঞ্জাবি, বাংলা, বাহাসা বা উর্দু জানেন, কোনো ব্যাপার না, আপনি আপনার নিজস্ব ভাষাতেই আল্লাহর সাথে কথা বলুন। আন্তরিকতার সাথে আপনার অপরাধগুলো স্বীকার করে নিন। কোনো অজুহাত দেখাবেন না। এইরকম করতে পারা আসলেই অনেক কঠিন। কারণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও আমরা নিজের সাথে মিথ্যা বলি। নিজেকে এভাবে প্রবোধ দেই – “আমি আসলে অতো খারাপ না। আমি যা করেছি তার কারণ আছে।” যখন আপনি আল্লাহর সামনে দাঁড়াবেন, নিজের কাজের বৈধতা দেয়ার কথা ভুলে যান। কারণ যেসব অজুহাতের মাধ্যমে আপনি আপনার কাজের বৈধতা দিতে চান, তিনি ইতোমধ্যে তার সবগুলোই জানেন। আল্লাহ জানেন আপনি কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি জানেন এটা কঠিন সময় ছিল, তিনি জানেন অমুক অমুক বিষয় আপনাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলেছিলো। ” ইয়া রব, আমি অনেক চাপের মধ্যে ছিলাম তাই মদ খেয়েছি।” তাঁকে...