যারা আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা চালায়

— উস্তাদ নোমান আলী খান রাসূলুল্লাহ (স) এর নবুয়তী জিন্দেগীর তেইশ বছরে যখনই কেউ ইসলামে প্রবেশ করেছে তার জন্য শুধু সাধারণ মুসলিম হিসেবে বসে থাকার সুযোগ ছিল না। তাকে ইসলামের মিশনকে তার নিজের জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহণ করে নিতে হয়েছিল। তুমি এই মিশনে যোগ দিয়েছ। এই মিশন সফল হউক বা ব্যর্থ হউক তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু তোমাকে এই মিশনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে যেতে হবে। তোমাকে এই মিশনের জন্য জীবনও দেয়া লাগতে পারে। তুমি এই উদ্দেশ্যে অবদান রেখেছ, মারা যাচ্ছ। যতদিন তুমি অবদান রেখে যাবে ততদিন তোমার জীবনের মূল্য আছে। এই উদ্দেশ্যে কুরবানী করার ক্ষেত্রে তুমি কখনো পিছপা হওনা। কারণ তুমি এটাকে কুরবানী হিসেবে দেখো না, তুমি এটাকে দেখো – إِنْ أَحْسَنتُمْ أَحْسَنتُمْ لِأَنفُسِكُمْ – “তোমরা ভাল কাজ করলে নিজেদের কল্যাণের জন্যই তা করবে।” (১৭:৭) এখন মাইন্ডসেটটি বোঝার চেষ্টা করুন। একজন সাধারণ মুসলিম এবং আল্লাহর পথে প্রচেষ্টারত সংগ্রামী ব্যক্তির মনোভঙ্গীর মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। আমি এখন এই ধরণের লোকদের ‘সংগ্রামী’ বলছি কিন্তু আসলে এদের মু’মিন বলা উচিত। একজন মুসলিম উদ্বিগ্ন থাকে ‘আমাকে সর্বনিম্ন কতটুকু করতে হবে, তা নিয়ে। ”আমি কি এটা খেতে পারবো? এটা কি হালাল? কত ওয়াক্ত নামাজ আমাকে আদায় করতে হবে? ৫ ওয়াক্ত, ঠিক? তাহাজ্জুদ পড়া কি বাধ্যতামূলক? ঠিকাছে, আমি তাহলে পাঁচ ওয়াক্তই পড়বো। আমাকে কি সব নফল পালন করতে হবে? আচ্ছা ঠিকাছে আমাকে শুধু মিনিমামটুকু দিন। আমি কি অমুক অমুক কাজগুলো করতে পারবো? আমাকে জাস্ট বলুন, কোনটা হালাল কোনটা হারাম। আমার তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। আমাকে কয়টি হজ্জ্ব করতে হবে? একটা? ঠিকাছে। যখন আমার হজ্জে যাওয়ার সামর্থ্য থাকবে, ঠিক না? হ্যাঁ। ঠিকাছে , আমি এগুলো করবো। ” এটাই মুসলিমের সংজ্ঞা। যে ইসলামের মিশনে যোগদান করে সে কখনো জিজ্ঞেস করে না ‘আমাকে সর্বনিম্ন কতটুকু...

আল-কুর’আন কি সহজ?

– উস্তাদ নুমান আলী খান আমরা মুসলিম জাতি কোনো বিষয়কে জটিল করতে ভালবাসি। কুর’আন ভালবাসে সহজ করতে। ইবরাহিম (আলাইহিসালাম) কোনো বিষয় সহজ করতে ভালবাসতেন। তিনি কোনো বিষয়কে জটিল করতেন না। তাঁকে যে পরীক্ষা দেওয়া হয়েছিল আমাদের সেই পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তিনি সোজাসুজি কথা বলতেন। আমরা হচ্ছি তাঁর জাতি। আমাদের উচিৎ কোনো বিষয়কে সহজ করে দেখা। এটা আমাদের শিখতে হবে। এই শিক্ষা নিতে হবে কুর’আন থেকে। কুর’আন সমস্ত বড় দার্শনিক ইস্যু, সন্দেহজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধান দেয় নবীগণ যেভাবে দিয়েছেন সেইভাবে। আমরা আল্লাহ প্রদত্ত পাঠ্যসূচি বদলিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশি মত করে নিই। আপনি যদি ইসলাম এর আকিদা বিষয়ের উপর PHD করতে চান, করুন। খুব ভালো কথা। কিন্তু তার আগে আপনার উচিৎ হবে ইব্রাহীম আলাইহিসালাম এর আকিদার (বিশ্বাস) উপর শিক্ষা নিন। মহান আল্লাহ্‌ সুবহানআল্লাহ সূরা ফাতিহায় ঈমান কি তা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর নিজের সম্পর্কে মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন। এটা কি যথেষ্ট নয়? আপনি হয়তো বলবেন আমি সূরা ফাতিহা পড়েছি কিন্তু আকিদা সম্পর্কে আরও বিশুদ্ধ ধারণা দরকার। মানুষজন হয়তো আপনাকে বলবে, আকিদা সম্পর্কে জটিল বিষয়গুলো নিয়ে অভিজ্ঞ কোনো শাইখের সাথে অলোচনা না করলে আপনার ঈমান মজবুত হবে না। আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন রাসূল সালাল্লাহু আলাইহিসালাম একদা কুর’আন পাঠরত অবস্থায় একদল জ্বিন তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা কূর’আন এর আয়াত শুনে মুগ্ধ হয়ে অতীব সুন্দর কিছু কথা বল্লো। যা আল্লাহ্‌ তাআলা পবিত্র কুর’আনে লিপিবদ্ধ করে রাখলেন। জ্বিনরা কি অনেক বড় কোনো আলেম, দাঈ ছিল? বা নবীজির (রা:) সাথে সাথে থাকতো? না। এরা এসবের কিছুই ছিল না। এরা ছিল ঈমানের অযোগ্য সাধারণ ছাত্র। মাত্র কয়েক মূহুর্ত কুর’আন শুনে এরা এতটাই মুগ্ধ ও আশ্চর্যান্বিত হলো যে তারা কুর’আন সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর কিছু কথা বললো আর এ কথাগুলো এতটাই মূল্যবান যে আল্লাহ তায়ালা সেগুলো কুর’আনে...

একটি সহজ জীবন

উস্তাদ নোমান আলী খান (সূরা আলাম নাশরাহ এর তাফসীর) ১। আজকের খুতবাহ কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে। যা আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা দুইবার উল্লেখ করেছেন সূরা ইনশিরাহ এর মাঝখানে, একে সূরা শার’ও বলা হয়। আল্লাহ বলেছেন – ” ফাইন্না মা’য়াল উস্রি ইয়ুস্রা, ইন্না মা’য়াল উস্রি ইয়ুস্রা।” সাধারণত এর অনুবাদ করা হয় – “কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে, নিঃসন্দেহে কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে।” এই আয়াতের এটাই গড়পড়তা অনুবাদ। তবে, সবার আগে কীভাবে ছোট ছোট সূরাগুলোর কদর করতে হয় সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। আপনাদের অনেকেই এই সূরাটি মুখস্ত করেছেন, আপনাদের বাচ্চারাও হয়তো মুখস্ত করেছে। এটা আমাদের ধর্মের খুবই সুন্দর একটি শিক্ষা এবং আমাদের জীবনের জন্যেও সুন্দর একটি শিক্ষা। আল-কুরআনের কিছু কিছু ছোট সূরার মাঝে গভীরতম শিক্ষা লুকিয়ে আছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর অপরিসীম প্রজ্ঞা থেকে সূরাগুলোকে সংক্ষিপ্ত রেখেছেন যেন মানুষ সহজেই এগুলো মুখস্ত করতে পারে। এবং এগুলো থেকে জীবনের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী কিছু শিক্ষা সহজে মনে রাখতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এমন একটি সময়ের কথা বর্ণনা করছেন যখন রাসূলুল্লাহ (স) তাঁর জীবনের কঠিন একটি সময়কাল অতিবাহিত করছিলেন। প্রথমদিকে তিনি যখন দীনের দাওয়াত প্রচার করে যাচ্ছিলেন, বেশিরভাগ মানুষ এই দাওয়াত শোনার প্রতি আগ্রহী ছিল না। আমাদের সময়কালের মত সময় সেটা ছিল না। সেই সময়টা হুদায়বিয়ার সন্ধি পরবর্তী সময়কালের মতও ছিল না, যখন দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। নবুয়তী মিশনের প্রথম দিকে মানুষ তাঁর জন্য কাজটা অনেক কঠিন করে তুলেছিল। যে কেউ রাসুলুল্লাহ (স) এর দাওয়াত গ্রহণ করতো, তাকে পাগল আখ্যা দেয়া হত, সুফাহা তথা বোকা এবং বুদ্ধিহীন বলা হত, অথবা বলা হত তিনি এদেরকে বোকা বানিয়েছেন। কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেই তাকে এই সমস্ত অভিযোগে অভিযুক্ত করা হত। সেই সময় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা এই গভীর অর্থপূর্ণ সূরাটি...

ভালো করে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন না, পড়তে কষ্ট হয়? তাহলে এই লেখাটি পড়ুন।

কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী নয় এইরকম একজন যুবক ভাই একদিন আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটা ছিল এইরকম – ‘আমি সবসময় ভালো করে কুরআন পড়ার চেষ্টা করি কিন্তু এত চেষ্টা করার পরও আমি শুদ্ধ করে পড়তে পারি না’। যুবকের কথা শুনে মনে হচ্ছিল সে খুবই আবেগী প্রকৃতির মানুষ। একদিন সে রেডিও তে কোন এক প্রোগ্রামে একটা ছোট বাচ্চার কুরআন তেলাওয়াত শুনছিল। সেই বাচ্চাটা এত সুন্দর করে পড়ছিল যে ওই প্রোগ্রাম এর শিক্ষক বলছিলেন, ‘সুবহানআল্লাহ! তোমার নফ্স, তোমার মন খুব পবিত্র। তুমি খুব পবিত্র। আর এই কারণে আল্লাহ তোমাকে এত সহজে, এত সুন্দর করে তেলাওয়াত করার ক্ষমতা দিয়েছেন’। তো এই কথা শুনে ওই যুবক চিন্তায় পড়ে গেল এবং ভাবতে লাগলো – আমি মনে হয় ভালো মানুষ না, এজন্যে আমি ভালো করে কুরআন পড়তে পারি না, আমার আত্মা পবিত্র না। এসব ভেবে সে মানসিকভাবে কষ্ট পেতে লাগলো। যদিও আমি নিশ্চিত ওই রেডিও প্রোগ্রামের শিক্ষক এইরকম কিছু বোঝাতে চান নি, তিনি নিছক সেই বাচ্চা ছেলেকে উংসাহ দেয়ার জন্য এইরকম কিছু বলেছিলেন। এই প্রেক্ষিতে আসুন আমরা একটা হাদিস দেখি, রাসুল (স) বলেছেন ‘কুরআন তেলাওয়াতে পারদর্শী ব্যক্তিরা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। কিন্তু যারা উচ্চারণগত বা অন্য কোন সমস্যা থাকা সত্বেও কষ্ট করে পড়ার চেষ্টা করে, তারা এর দ্বিগুন পুরস্কার পাবে। (সহি মুসলিম)’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঐসব লোক কাদের তুলনায় এই দ্বিগুন পুরস্কার পাবে? সাধারণ তেলাওয়াতকারীদের তুলনায়? নাকি তেলাওয়াতে পারদর্শিদের তুলনায়? আমার মতে তেলাওয়াতে পারদর্শীদের তুলনায় এই দ্বিগুন পুরস্কার দেয়া হবে। কারণ একজন মানুষ কতটুকু অর্জন করলো আল্লাহ সেটাকে গুরুত্ব দেন না, আল্লাহ গুরত্ব দেন সে কী পরিমান চেষ্টা করলো সেটাকে। আমরা মানুষরাই অর্জনকে বেশি গুরুত্ব দেই, সবসময় দেখতে চাই ফলাফল কি, লাভ কতটুকু হলো? আমরা কতটুকু জানি, কতটুকু মুখস্ত করলাম, কতটুকু পড়লাম এই ধরনের...

সবচেয়ে বিশুদ্ধ বুদ্ধির মানুষ কারা?

— নোমান আলী খান। মানুষের মাঝে যাদের সবচেয়ে পরিপক্ক ঈমান রয়েছে কুরআনে তাদের জন্য একটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, আর তা হলো – উলুল আলবাব বা সবচেয়ে পরিশুদ্ধ বুদ্ধির মানুষ। আল্লাহ এই মানুষদের কথা সূরা আলে-ইমরানে বলেছেন – إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ – “নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্র ও দিনের আবর্তনে জ্ঞানবানদের (উলুল আলবাবদের) জন্য বহু নিদর্শন আছে।” (৩:১৯০) তারা ঈমানের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানে এবং ঈমানের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে এক ধরণের পরিপক্কতায় পৌঁছে গিয়েছে, এমনকি কুরআনের সংস্পর্শে আসার পূর্বেই। সবচেয়ে পরিণত ঈমানের মানুষেরা ঐশী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাওয়ার পূর্বেই নিজেদের ভেতর বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলেছিলেন। চলুন দেখি, কীভাবে? আল্লাহ বলেন – “ইন্না ফিই খালকিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখতিলাফিল লাইলী ওয়ান নাহারি…” নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টিতে এবং রাত্র ও দিনের আবর্তনে “লাআ-ইয়াতিন” অলোকিক নিদর্শন রয়েছে, শুধু একটা নয়, বহু বহু নিদর্শন রয়েছে এর প্রত্যেকটাতে। রাতের মাঝে অনেক শিক্ষা আছে, দিনের মাঝে অনেক শিক্ষা আছে, আকাশের মাঝে অনেক শিক্ষা আছে, পৃথিবীর মাঝেও অনেক শিক্ষা আছে। এর প্রত্যেকের মাঝে রয়েছে অনেক অনেক শিক্ষা। কার জন্য? উলুল আলবাব-দের জন্য। সবচেয়ে পরিশুদ্ধ বুদ্ধির মানুষদের জন্য, খাঁটি বুদ্ধিমত্তার অধিকারী মানুষদের জন্য। এখন, খাঁটি বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞা কী? আল্লাহ কিভাবে খাঁটি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন? তিনি পরবর্তী আয়াতে “উলুল আলবাব-দের” পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন – الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ – যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে…. তাহলে উলুল আলবাবদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, যারা সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, “ওয়া ইয়াতা ফাক্কারুনা ফিই খালিকস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ” এবং তারা আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে। তাহলে এখন দেখুন…...