মনের অস্থিরতা দূর করার উপায়

  – নোমান আলী খান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এরশাদ করেনঃ  اِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوۡعًا ۙ  “সে(মানুষ)বিপদগ্রস্থ হলে হা-হুতাশ করতে থাকে।” (৭০ : ২০) অর্থাৎ, যখন মানুষ ব্যর্থ হয় কিংবা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তারা খুব তাড়াতাড়ি অধৈর্য হয়ে পড়ে আর হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। এমনকি আল্লাহর নির্দেশ না মেনে পাপ কাজে লিপ্ত হয় বা অসংযত আচরণ করে।  এখানে ‘জুজুয়া’(جَزُوۡعًا)শব্দটি ‘সবর’(صَبْر)এর বিপরীত। মূলতঃ এটি দ্বারা মানুষের মনের অসহনশীল প্রকৃতিকেই তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক- আমরা কোন পরীক্ষায় খারাপ করলাম কিংবা ব্যবসায় বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হলাম। এরপর সচরাচর আমরা যা করি তা হলো প্রথমেই মন খারাপ করে বসে বসে ভাবি আমি হয়তো শেষ। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ আমাকে পরিত্যাগ করেছেন, তিনি আর আমার দুঃখ-দুর্দশা বা প্রয়োজনের দিকে খেয়াল করেন না।.. এমনকি মানুষকে এটাও বলতে শোনা যায়, ‘আমি যতই আল্লাহর আনুগত্য করি না কেন, জীবনে স্বস্তি তো আসেই না বরং তা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। এসব আল্লাহর ইবাদাত করে আমার ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না’। হতাশা কাটানোর জন্য তারা বিভিন্ন নিষিদ্ধ কার্যকলাপে আসক্ত হয়ে পড়ে, যেমন- মদ, ড্রাগ, অবৈধ মেলামেশা ইত্যাদি। …  মজার বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমাদের এই স্বভাবগত অসহনশীল প্রবণতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন। তাই এই আয়াতে আমাদেরকে কোনো দোষারোপ করছেন না, বরং তিনি জানেনই যে মানুষ আসলেই মানসিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল এবং তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল; কঠিন পরিস্থিতিতে তারা ধৈর্য হারাবে এবং নিজেকে আত্মসংবরণ করতে না পেরে ভুল পথে পা বাড়াবে, পাপাচারে লিপ্ত হবে; তারা আসলেই অস্থির বা ‘জুজুয়া’(جَزُوۡعًا)। এর পরের আয়াতে আল্লাহ্‌ উল্লেখ করেছেন – وَاِذَا مَسَّهُ الۡخَيۡرُ مَنُوۡعًا ۙ‏ ” আবার যখন(সে)ঐশ্বর্যশালী হয় তখন কৃপণ হয়ে যায়।”(৭০:২১)  তার মানে, আল্লাহ্‌ তাআলা মানুষের উপর কোন রহমত দান করেন তখন তারা এতটাই কৃপণ আর ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে যে, সবকিছু একাই...

আপনার পা কিনতে চাই, মূল্য কত ?

— নোমান আলী খান  আল্লাহ তায়ালা বলেন – لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضْلِهِ ۚ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ – “যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী।” (৩৫:৩০)  আজ আমি আপনাদের সাথে আল কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর একটি অনন্য এবং অসাধারণ নাম সম্পর্কে আলোচনা করবো। এই নামটি অনন্য কারণ আল্লাহ এই একই নাম তাঁর নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন আবার বিশ্বাসীদেরকেও এমন হতে বলেছেন। আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে বলেছেন – وَقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ – “এবং আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই শাকুর”। (৩৪:১৩)  ‘শাকুর’ অর্থ – চরম কৃতজ্ঞ এবং চরম গুণগ্রাহী।(appreciative)  আর কৃতজ্ঞ হওয়া এবং গুণগ্রাহী হওয়া দুটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। কৃতজ্ঞ মানে কেউ যদি আপনার কোনো উপকার করে, তাহলে আপনি তাকে ‘থ্যাংক ইউ বা ধন্যবাদ’ বলেন এবং মনে মনে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন। ‘গুণগ্রাহী’ মানে আপনি সবকিছুতে ইতিবাচকতা প্রত্যক্ষ করেন। সব পরিস্থিতিতেই আপনি ভালো কিছুর সন্ধান পেয়ে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি খারাপ হলেও আপনি তাতে ভালো কিছু হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী থাকেন।  আমাদের রাসূলুল্লাহ (স) এর জীবনে অন্যতম দুর্বিষহ একটি ঘটনা ছিল ‘ইফকের ঘটনা’, যখন মদীনাতে তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অপমানজনক অপবাদ রটনা করা হয়। আর এই মিথ্যা অপবাদ রটনার কাজ ত্রিশ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। ত্রিশ দিন পর আল্লাহ নাজিল করেন –  لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم ۖ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ – “এটাকে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে করো না, বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।” (২৪:১১)  তো, এভাবে আল্লাহ আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করেন এবং তিনি চান আমরা যেন শাকুর হই। যার অর্থ চরম গুণগ্রাহী হওয়া, চরম তারিফ করা, আল্লাহর তারিফ করার জন্য উপায় খোঁজা, কৃতজ্ঞ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা। ‘শাকুর’ এর এই অর্থ আমাদের জন্য। আর আমাদের জন্য ব্যাপারটা উপলব্ধি করা সহজ।   কিন্তু...

একজন মানুষ কিভাবে তাওবা করবে?

খুব সংক্ষেপে বলছি।  এক নাম্বার: তাওবা করার ক্ষেত্রে আন্তরিক হওয়া। তাওবা হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।  দুই নাম্বার: সত্যিকারের অনুশোচনা থাকতে হবে এবং নিজেকে অপরাধী মনে করতে হবে। এটা ছাড়া কোনো তাওবা নেই। তাওবা অন্তর থেকে আসতে হবে। আর অন্তরকে উপলব্ধি করতে হবে যে, আমি অন্যায় করেছি। আমি ভুল করেছি। আমার ঐ টাকাটা নেওয়া উচিত হয়নি। আমার অমুক কাজটি করা ঠিক হয়নি। আমার ঐটা খাওয়া বা পান করা উচিত হয়নি। যে কাজটি আমি করেছি তা করা উচিত হয়নি। অন্তরে খাঁটি অনুতাপ থাকতে হবে।  আমাদের রাসূল (স) বলেছেন – তাওবার মূল হল অনুশোচনা অনুভব করা। (আন-নাদামু তাওবা) অনুতাপ অনুভব করা তাওবার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। তাহলে, দুই নাম্বার হল, অনুশোচনা অনুভব করা।  তিন নাম্বার: ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করা জিহ্বা দিয়ে। আপনি আল্লাহর কাছে এভাবে চাইবেন – ইয়া গাফ্ফার! ইয়া তাউয়াব! ইয়া রাহমান! আমাকে মাফ করে দিন। এরপর, তাওবা যথাযথ করতে হলে ….. এতক্ষণ যা বলেছি তা হল সর্বনিম্ন। আর তাওবাকে পূর্ণ করতে হলে….আর আল্লাহ আমাদের কাছে পূর্ণাঙ্গ তাওবা আশা করেন, তিনি বলেন – হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা। একটি যথাযথ তাওবা। আর তাওবাকে যথাযথ করতে হলে আমাদেরকে আরো দুইটি শর্ত এর সাথে যোগ করতে হবে।  যদি এই দুইটি শর্ত পূরণ করা না হয়, তাহলে তাওবা পরিপূর্ণ হবে না। এটা হয়তো সি গ্রেইড, এ গ্রেইড নয়। তাওবাটা পূর্ণাঙ্গ নয়।  শেষ দুইটি শর্ত একটি যথাযথ তাওবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হল, পাপটি ভবিষ্যতে আর না করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। কারণ, যে ব্যক্তি এটা জেনে তাওবা করে যে সে এই পাপটি আবার করবে, সে তাওবাকে পূর্ণ করলো না। এটি পরিপূর্ণ আন্তরিক তাওবা নয়। আমি বলছি না যে এটা মিথ্যা তাওবা। না, এটা অর্ধ-হৃদয়ের তাওবা। এটা খাঁটি তাওবা নয়। কোন...

নূরুন ‘আলা নূর

— উস্তাদ নোমান আলী খান  আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা বলেন –  اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِن شَجَرَةٍ مُّبَارَكَةٍ زَيْتُونِةٍ لَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ نُّورٌ عَلَى نُورٍ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَن يَشَاء وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ আল্লাহ হলেন সমস্ত আসমান ও যমীনের নূর (আলো)। তাঁর নূরের দৃষ্টান্ত হলো যেন একটি তাক – যার ভিতরে রয়েছে একটি প্রদীপ; প্রদীপটি রয়েছে একটি স্বচ্ছ কাঁচপাত্রের আবরণের ভিতরে; কাঁচটি (নিজেও) যেন একটি উজ্জ্বল তারকা, যা প্রজ্জ্বলিত করা হয় বরকতময় যায়তুন গাছ (থেকে নিসৃত তেল) দ্বারা; যা পূর্বমুখি নয়, আবার পশ্চিমমুখিও নয় (বরং উভয়দিক থেকেই আলোপ্রাপ্ত, সর্বদা প্রজ্জ্বলিত)। আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও সেই তেল এতই বিশুদ্ধ স্বচ্ছ যে (তাতে আগুন না দিলেও) তা যেন নিজে নিজেই জ্বলে উঠার নিকটবর্তী। আলোর উপরে আলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন তার নূরের দিকে পথ দেখান। আল্লাহ মানুষের (বোঝানোর) জন্য (এসব) দৃষ্টান্ত পেশ করেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।  [সূরা নূরঃ ৩৫] আপনাদের অনেকেই এই আয়াতের সাথে পরিচিত। এর সাধারন অনুবাদ করা হয় “আল্লাহ হলেন আকাশ এবং পৃথিবীর জ্যোতি।” পরবর্তী কয়েক মিনিটে আমি এই আয়াতগুলো নিয়ে আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই।  ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে পারি, আল্লাহর কিতাবকে গভীরতার বিভিন্ন ধাপে অধ্যয়ন করা যায়। আর আল্লাহর এই কিতাবের গভীরতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এর কোনো শেষ নেই। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে এই কিতাব নিয়ে অধ্যয়ন করছি। এই অভিজ্ঞতার ফলে আমি একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এমনকি একটি আয়াত নিয়ে অনেক অধ্যয়ন করার পরও আপনি কেবল আপনার সামর্থ অনুযায়ী অল্পই জ্ঞান লাভ করতে পারেন। তারপর যখন এই আয়াত নিয়ে এমন কারো ব্যাখ্যার সন্ধান পান...

মৌমাছির মত হও।

— নোমান আলী খান  আল্লাহ তায়ালা বলেন – وَأَوْحَىٰ رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ – আর তোমার রব মৌমাছিকে আদেশ দিলেনঃ ‘তুমি পাহাড়ে ও গাছে এবং তারা যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে নিবাস বানাও।’  ثُمَّ كُلِي مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا ۚ يَخْرُجُ مِن بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِّلنَّاسِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ – “অতঃপর প্রত্যেক ফল থেকে আহার কর, অতঃপর তোমার প্রতিপালকের (শিখানো) সহজ পদ্ধতি অনুসরণ কর। এর পেট থেকে রং-বেরং এর পানীয় বের হয়। এতে মানুষের জন্য আছে আরোগ্য। চিন্তাশীল মানুষের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন আছে।” (16:68-70)   একজন মুসলিমের চিন্তাপদ্ধতি অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন। এর কারণ হল আল্লাহর বই। এটা আমাদের চিন্তা ধারাকে রূপদান করে। বস্তুত, আজ আমি আলোচনা শুরু করতে চাই সূরা মূলকের একটি আয়াত দিয়ে। যেখানে বলা হয়েছে –  লোকেরা জাহান্নামে প্রবেশ করছে, আর প্রবেশ করা কালে তাদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। তখন, তারা উত্তরে বলবে,  وَ قَالُوۡا لَوۡ کُنَّا نَسۡمَعُ اَوۡ نَعۡقِلُ مَا کُنَّا فِیۡۤ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ  – বিখ্যাত একটি আয়াত –  “এবং তারা বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম…চলুন, এখানে একটু থামি। এখানে কী শুনার কথা বলা হচ্ছে? যদি কুরআন শুনতাম! যদি ইসলামের বার্তা শুনতাম! যদি উপদেশগুলো শুনতাম! এই অংশটি সবাই বুঝে। কিন্তু এরপর আয়াতে ‘ও না’কিলু’ বলা হয়নি, বলা হয়েছেঃ ‘আও না’কিলু’, লাও কুন্না নাস্মাউ’ আও না’কিলু। আর আরবিতে ‘আও’ অর্থঃ অথবা। যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম। অর্থাৎ, যদি শুনতাম অথবা অন্ততপক্ষে চিন্তাভাবনা করতাম।  কথাগুলো এভাবে উপস্থাপনের পেছনে শক্তিশালী উদ্দেশ্য রয়েছে। একদিকে, মুসলমানরা কিছু শুনলে সেখান থেকে শেখার চেষ্টা করবে। আমরা খুৎবা শুনি, রিমাইন্ডার শুনি, লেকচার শুনি, কিছু পড়লেও আমরা ঐখান থেকে শিখি। এগুলো থেকে আমরা...