প্রত্যাশার মাস রামাদান (৪র্থ পর্ব)

আজকের খুৎবার পরিসংহারে এসে আমি এই মাসের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ উপহার নিয়ে কথা বলতে চাই। রামাদানের আয়াতে অনেকগুলো উপহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আমি শুধু একটি উপহার নিয়ে কথা বলতে চাই। আশা করি, আমি আপনি এর সুযোগ পরিপূর্ণরূপে কাজে লাগাতে পারবো। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল বলেন – وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ – “আর আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে।”  আল্লাহ এখানে বলেন নি, যদি আমার বান্দারা জিজ্ঞেস করে, তিনি বলেছেন, যখন আমার বান্দারা জিজ্ঞেস করে। কারণ তিনি আশা করেন যে, এটা অবশ্যই ঘটবে। তিনি আপনার সম্পর্কে আশাবাদী। আপনি হয়তো আপনার সম্পর্কে আশাবাদী নাও হতে পারেন, কিন্তু আল্লাহ আপনাকে নিয়ে আশাবাদী। তিনি রাসূল (স) কে বলেন, যখন তারা আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে….. সাধারণভাবে আয়াতটি তো এমন হওয়ার কথা ছিল, যখন তারা আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, আপনি তাদের বলে দিন আমি নিকটে। কিন্তু আয়াতের বক্তব্য এটা নয়, আয়াতের বক্তব্য হলো – যখন তারা আপনার নিকট আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে… এটা বলার পর তিনি তাঁর রাসূলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে আমার আপনার সাথে সরাসরি কথা বলা শুরু করলেন এবং বলেন – নিশ্চিতভাবেই আমি সন্নিকটে। আয়াতের মাঝখানে এসে বক্তব্যটি আর আল্লাহ এবং রাসূল (স) এর সাথে না হয়ে আল্লাহ এবং আমার আপনার সাথে সরাসরি হয়ে গেলো। বহুদিন যাবৎ আপনি হয়তো আল্লাহর সাথে কথা বলেন না। আপনি যদি কারো সাথে অনেক দিন কথা না বলেন, আপনার মনে হতে পারে সেও হয়তো আপনার সাথে কথা বলতে চায় না। “এতদিন কোথায় ছিলে তুমি?” আপনি অন্য একজনের মাধ্যমে তার সাথে কথা বলতে চান। সে কি এখনো আমার প্রতি রাগান্বিত?আপনি তার সাথে সরাসরি কোনো যোগাযোগ করতে চান না। কিন্তু আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল সেই দেয়ালটি ভেঙে...

উম্মতের জন্য রাসূল (স) এর ভালবাসা

এই উম্মতের জন্য রাসূল (স) এর ছিল অগাধ ভালবাসা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন ঃ لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ “তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রসূল।” عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ “তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ।” حَرِيصٌ عَلَيْكُم তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী। হারিস শব্দটি সন্তানের প্রতি পিতা মাতার ভালবাসা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। তিনি তোমাদের ভালোর জন্য বেশ আগ্রহী। بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। আল্লাহ রাসূল (স) এর জন্য এমন দুটি শব্দ ব্যবহার করেছেন যার শুরুতে আলিফ লাম যুক্ত করে আল্লাহর দুটি নাম প্রকাশ করা হয়। আর রাউফ , আর রাহিম। আলিফ লাম কেটে দিয়ে মানুষের জন্য শব্দ দুটি ব্যবহার করা যাবে। সুতরাং আর রাউফ এবং আর রাহিম রাসুল (স) কে রাউফ এবং রাহিম বলে বর্ণনা করেছেন। কাদের প্রতি তিনি রাউফ এবং রাহিম ? মুমিনদের প্রতি। বিশ্বাসীদের প্রতি তিনি রাউফ। রাউফ শব্দের অর্থ হলো চরম স্নেহশীল, রাহিম হলো সাধারণ দয়া। রাউফ হলো বিশেষ ধরণের দয়া। মাতা পিতার সন্তানের প্রতি যে ভালোবাসা তাকে রা’ফা বলে। সুতরাং আল্লাহ যিনি আর রাউফ তিনি রাসুল (স) কে মুমিনদের জন্য রাউফ হিসেবে বর্ণনা করছেন। রাসূল (স) একবার কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন আর তিনি কিছু বিশেষ আয়তের সংস্পর্শে এলেন … তার একটা হলো বিখ্যাত এই আয়াতটি, যখন ইব্রাহীম (আঃ) বলেন – رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِّنَ النَّاسِ ۖ فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (সূরা ইব্রাহীম ৩৬)। ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য দোয়া করছেন – “ও আল্লাহ! যে আমার অনুসরণ করে, সে আমার। এবং কেউ আমার অবাধ্যতা করলে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” ও আল্লাহ! এমনকি তাঁকেও ক্ষমা করে দিন। এটাই ইব্রাহীম (আঃ) বলছিলেন- যে আমার অনুসরণ করে সে আমার সাথে আছে, তাকে রক্ষা করুন। কিন্তু যারা আমার অবাধ্য হয়...

আল্লাহ নামের পরিচিতি

আমরা আল্লাহর কয়েকটি নাম এবং গুণাবলী নিয়ে আমাদের আলোচনা আবার শুরু করছি। অবশ্যই আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রধান এবং সর্বাধিক পরিচিত নাম দিয়ে শুরু করবো আর সে নামটি হলো ‘আল্লাহ।’ আমাদের মালিক এবং সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে পরিচিত এবং কমন নাম হলো আল্লাহ। কুরআন মাজীদে এই নামটি অন্যান্য নামের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক বার ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন মাজীদে এই নামটি প্রায় ৩ হাজার পাঁচ শত বার উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন শুরু করা হয়েছে এই নামটি দিয়ে। …. বিসমিল্লাহির রাহ মানির রাহিম। আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। কুরআনের সমাপ্তিও হয়েছে এই নামটি দিয়ে। … কুল আঊযু বিরাব্বিন নাসি মালিকিন নাসি ইলাহীন নাস। এই নামটি পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোতেও পাওয়া যায়। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রাচীনতম যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় তাতে এমন এক ঈশ্বরের কথা উল্লেখ আছে যার উচ্চারণ “আল্লাহ” শব্দের উচ্চারণের কাছাকাছি। এই নামটি আমরা ওল্ড এবং নিউ টেষ্টামেন্টেও পাই ‘ইলো এবং ইলোহিম’ হিসেবে। তাই এই নামটি প্রাচীন সভ্যতার মানুষদের কাছেও পরিচিত ছিল। কুরাইশদের নিকটও এই নামটি পরিচিত ছিল। বিস্ময়কর একটা ব্যাপার হলো, প্রাচীন ব্যাবিলন এবং কুরাইশদের নিকট “আল্লাহ” ছিলেন সকল ঈশ্বরের ঈশ্বর। তিনি ছিলেন প্রধান ঈশ্বর। তারা কখনো আল্লাহর জন্য কোনো মূর্তি তৈরী করেনি। কুরাইশরা আল্লাহকে চিনতো; তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ – (৪৩: ৮৭) আপনি যদি কুরাইশদের জিজ্ঞেস করেন কে তোমাদের সৃষ্টি করেছে, তারা বলবে আল্লাহ। সুতরাং তারা আল্লাহ নামটি সম্পর্কে জানতো। কখনো কখনো তারা আল্লাহর উপাসনাও করতো। কিন্তু তারা আল্লাহকে অনেক বেশি পবিত্র মনে করতো। মোটকথা আল্লাহ নামটি তাদের নিকট জানা ছিল। এখন “আল্লাহ” শব্দটির অর্থ কী? এ সম্পর্কে অনেক অনেক মতামত রয়েছে, কিন্তু সময় স্বল্পতার দরুন সবগুলো মতামত আলোচনা করা সম্ভব নয়। একটি দলের মতে, আল্লাহ নামটি কোথাও থেকে উদ্গত (non-derived) হয়নি, এটি একটি প্রপার নাউন...

প্রত্যাশার মাস রামাদান (৩য় পর্ব)

আর বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনারা অনেকেই হয়তো মনে করেন যে আপনি একসময় আল্লাহর অনেক কাছাকাছি ছিলেন। “আমি অনেক ভালো মানুষ ছিলাম” বা “আমার হৃদয় এখনকার চেয়ে আগে আরও পরিষ্কার ছিল।” কোন কারণে হয়তো আপনি সেই পথ হারিয়ে ফেলেছেন আর অনেক দূরেও চলে গিয়েছেন। এখন আপনার মনে হচ্ছে যে আপনি আল্লাহর কাছ থেকে এতই দূরে চলে গিয়েছেন যে আপনার জন্য আর কোন আশা নেই। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আপনি একদম হারিয়ে গেলেন! আর আমি আপনাকে এতটা বলতে পারিঃ আপনি বা আমি আল্লাহর কাছ থেকে নিজেদের যতই দূরে মনে করি না কেন, আল্লাহ প্রথম যেই মানুষটিকে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন সেই দূরত্বের সাথে আমাদের এই দূরত্বের তুলনা চলে না। সেটা খুবই বড় ডিমোশন ছিল। এমন একজন যিনি আল্লাহর এতো নিকটে ছিলেন যে, আল্লাহ সরাসরি তাঁর সাথে কথা বলতেন। তারপর আল্লাহ তাঁকে বললেন, তোমার সাথে আর সরাসরি কথা বলবো না, এখন থেকে তোমার সাথে ওহী পাঠানোর মাধ্যমে কথা বলবো। এতো বড় ডিমোশন সত্ত্বেও তাঁর আশা ছিল যে, আল্লাহর পাঠানো ওহীর মাধ্যমে আমি আবার আল্লাহর কাছাকাছি হতে পারবো। কুরআন আপনাকে জাহান্নামে পাঠাতে আসেনি। কুরআন তো বলছে না যে আপনার কোন আশা নেই। কুরআন আল্লাহর প্রতিজ্ঞা যে আমরা যতই ভুল করি বা আল্লাহর কাছ থেকে দূরে চলে যাই না কেন, আমরা আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) এর মত মতো হবো এবং তাওবা করে ফিরে আসবো। আমরা কখনোই ইবলিসের মতো হবো না। ইবলিস… আর আরবিতে ‘আবলাসা’ ক্রিয়ার একটি অর্থ হল আশা ছেড়ে দেয়া। আমরা নিরাশ হবো না। আমরা নিজেদের মাঝে আশা ধরে রাখবো। আর যখন আপনি নিজেকে বলতে থাকেন যে আপনার জীবনের আর অর্থ নেই, “আমি খারাপ মানুষ, আমার কী-ই বা আর করার আছে?” আপনি যখন এমনটা বলা শুরু করছেন, তখন আপনি আসলে ইবলিসের সুন্নত/পথ...

প্রত্যাশার মাস রামাদান – ২য় পর্ব

একটু কল্পনা করুন, আদম (আ) এর কেমন খারাপ লাগতো! যখন তিনি ভাবতেন যে, তিনি আল্লাহর কত নিকটে ছিলেন, আর এখন তিনি আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা থেকে কত দূরে! তাকে এতো বেশি সম্মান এবং মর্যাদা দেয়া হয় যে ফেরেশতাদের পর্যন্ত নির্দেশ দেয়া হয় তাঁকে সেজদা করার জন্য। আর এখন তিনি এই পৃথিবীতে। প্রসঙ্গক্রমে, যে আয়াতে তাঁকে পৃথিবীতে নেমে যাওয়ার জন্য বলা হয় – اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ – ” তোমরা সবাই নীচে নেমে যাও।” এখানে আমাদের পিতা আদম (আ), আমাদের মা হাওয়া (আ) এবং ইবলিশ তিনজনকেই নীচে নেমে যাওয়ার জন্য বলা হয়। অর্থাৎ – এখন আমাকে এই জায়গা ইবলিশের সাথে শেয়ার করতে হবে! আমি ফেরেশতাদের সাথে থাকতাম আর এখন ইবলিশ এবং তার চেলা-চামুন্ডাদের সাথে থাকতে হবে?? আমার অবস্থাটা কেমন হয়ে গেল। এটা অপমানকর। তাঁর উপর তিনি আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল থেকে দূরে থাকার বেদনা তো অনুভব করতেনই। আল্লাহ তাকে এভাবে পাঠিয়ে দেয়ার সময় বললেন তোমার এবং তোমার সন্তানদের এখানে আবার উঠে আসার সুযোগ রয়েছে। তোমাদেরকে নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু আবার উঠে আসার সুযোগ রয়েছে। তাই আল্লাহ তাকে বলেছেন – فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ – “অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।” জান্নাত থেকে নেমে যাও। কিন্তু যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো পথনির্দেশনা আসবে…এখানে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ শধু আদম (আ) নয় বরং তার সন্তানদের প্রতিও যদি কোনো পথনির্দেশনা আসে, ইতিহাসের যে কোনো সময়…. যখন আমি হেদায়েত পাঠাবো তখন যে কেউ তা মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিবে তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না’। তাদের কোন ভয় থাকবে না...