— উস্তাদ নোমান আলী খান
আপনাদের সাথে মুসা আলাইহিস সালামের কাহিনীর একটি অংশ আজ শেয়ার করতে যাচ্ছি। যা ঘটেছিল – মূসা আলাইহিস সালাম দুজন নারীকে সাহায্য করেন যারা তাকে উত্তম বিবেচনা করে তাদের ঘরে আমন্ত্রণ জানায় যাতে অর্থের বিনিময়ে তিনি তাদের জন্য কাজ করেন। তিনি তাদের ঘরে আসেন আর নিজের কাহিনী বিস্তারিত তাদের বলেন – কিভাবে তিনি মিশর থেকে পালালেন, আর সেখানে কিভাবে তাকে হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে, এবং তিনি যে গৃহহীন ও আশ্রয় পেতে আগ্রহী ইত্যাদি। সেই নারীরা ঘরের অন্য পাশ থেকে সব শুনছিলেন, তন্মধ্যে একজন তাদের পিতাকে ডাকলেন আর তাকে কিছু জানালেন। এই বিষয়টি কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে, অর্থাৎ এটি গুরুত্বপূর্ণ। সে নারীটি পিতাকে ডেকে বললেন,
يا ابت استاجره
প্রিয় আব্বা, তাকে কাজের জন্য নিয়ে নিন।
দারুন। এই বৃদ্ধ লোকটির দুটি কন্যা রয়েছে, কিন্তু কোন পুত্রসন্তান নেই, স্বাভাবিক যে এ কারনেই তাকে তাঁর মেয়েদেরকেই পাঠাতে হয় যেকোন কাজের জন্য। মেয়েটি ভাল করেই জানে, যদি মুসাকে কাজের জন্য নেয়া হয় তাহলে তাকে অবিবাহিত এই নারীদের আশেপাশেই কাজ করতে হবে – যা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তো সে জানে বা বুঝতে পারছিল যে যদি তাকে ভাড়ায় নেয়া হয় – সুযোগ থাকে তাদের দুইজনের একজনের সাথেই তাঁর বিয়ে হবে । আর সে নিজেই যখন এই কথা বলছে, সুযোগ বেশি যে আব্বা তার ইংগিত বুঝবে – আব্বা, আমার মনে হয় বিবাহের জন্য সে এক উত্তম পুরুষ।
তো প্রথমেই যে বিষয়টি এখান থেকে আপনারা বুঝতে পারেন, এই নারীর আত্মবিশ্বাস ছিল যে সে নিজের বিয়ের জন্য আব্বাকে কারও সম্পর্কে বলতে পারে। কোন কন্যাসন্তান বিবাহের ব্যাপারে কোন ছেলের প্রতি আগ্রহী থাকলে, তার পিতাকে ইঙ্গিত দিয়ে জানানোতে কোনই অন্যায় নেই। বড় একটি বিষয় যা এখান থেকে পাওয়া যায়। এতে কোন ক্ষতি নেই, লজ্জার ও কিছুই নেই। দ্বিতীয় যে বিষয়টি এখান থেকে বোঝা যায়, দেখুন বাবাদের সংকেত বোঝা উচিত। আমাদের কন্যারা স্বভাবতই লাজুক। তারা লজ্জা পেয়েই সরে যায়। তারা সাধারণত কখনোই সরাসরি সামনে এসে বলবে না – আব্বা, তাকে একটু দেখুন ! সে তো অসাধারণ, আমার তাকে খুবই পছন্দ হয়! তাকে কি আমি বিয়ে করতে পারি ? সে এভাবে বলবে না ! সে বলবে তাকে কাজে নিয়ে নিন।
তৃতীয় ব্যাপার হচ্ছে, সে জানে যে এটি একটি নাজুক বিষয় ৷ তাই সে তার পিতাকে শুধুই
استاجره
‘তাকে কাজে নিন’ বলেনি। বলেছে,
يا ابت استاجره
‘আমার প্রিয় আব্বু, তাকে কাজের জন্য নিয়ে নিন’
সে শুধু আব্বা বলেনি, প্রিয় বা স্নেহপূর্ণ আব্বা বলেছে।
এখানে
التاء
تشير الحب التكريم
‘আবাতি’ শব্দে যে “তা” ব্যবহৃত হয়েছে সেটি ভালবাসা ও সম্মান বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ‘ আব্বা আমি আপনাকে ভালবাসি আর আপনাকে অনেক সম্মান করি, তাকে নিয়ে নিন ! ‘ – সে এমনটাই করলো। সে তার বাবাকে প্রথমে নরম করলো,যখন সে এভাবে বললো। এবং অবশ্যই তার কথার পেছনে যুক্তি ছিল, আপনি তাকে কেন কাজে নেবেন –
إن خير من استاجرت القوي الامين
যোগ্য মানুষ যাকে আপনি কাজে নিয়োগ দিতে পারেন, তার হওয়া উচিত সবচাইতে শক্তিশালী, সৎ। আর শেষ শব্দগুলোও দারুন, কেননা সাধারণত আরবীতে বলা হয় ‘কোন শক্তিশালী বা কোন সৎ ব্যক্তি’ কিন্তু সে এখানে বললো ‘সবচাইতে শক্তিশালী, সবচাইতে সৎ’ – এখানে ‘দ্যা’ আর্টিকেলটি ব্যবহারের মাধ্যমে সে বোঝালো – আমি শক্তিশালী যেকোন পুরুষে বা যেকোন সৎ মানুষেই আগ্রহী নই, আসলে আমি তাঁর চাইতে শক্তিশালী কাউকে আগে দেখি নি, তাঁর চাইতে বেশি সৎ কোন মানুষও আগে দেখি নি – এতটাই সৎ যে সে এখানে এসে তাঁর আইনি জটিলতার অতীত, সব আমাদের বলে দিল, সে কেমন ভুল করছিল সব বলে দিল।
আরেকটা অসাধারণ শিক্ষা যা আমরা এই একই আয়াত থেকে পাই – সেটা হচ্ছে মুসা আলাইহিস সালাম এমন একটি মেয়ে থেকে প্রস্তাব পেল যে জানে তিনি গৃহহীন, হত্যার পলাতক আসামি, পুরোপুরি নিঃস্ব – ভাই হয়তো আপনি বিয়ে করতে পারছেন না কারন আপনার জীবনবৃত্তান্ত অতটা আকর্ষণীয় নয়, মূসা আলাইহিস সালামের জীবনবৃত্তান্তটিও আকর্ষণীয় নয়, সেটা কোনভাবেই আকর্ষণীয় দেখায় না। কিন্তু আপনারা জানেন তাঁর কি আছে – তাঁর সামর্থ্য আছে যা তিনি তাঁর কাজ ও চরিত্রের মাধ্যমে প্রদর্শন করেছেন। তিনি সে নারীদের সাথে জোর করে কথা বলেননি, আদর্শবান মানুষ হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন। তিনি আসলেন আর উত্তম কারন থাকায় তাদের সাহায্য করলেন, কেননা তাদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। আর তারপর সরে পরলেন। তাদের কাছে তিনি ভিক্ষা চাননি, টাকাপয়সা খুঁজেন নি, এমন কিছুই তিনি করেননি। যা তাঁর চারিত্রিক বলিষ্ঠতা, সততা প্রমান করে। অর্থাৎ তিনি তাঁর চরিত্র সামনে তুলে ধরেছেন। উত্তম চরিত্র আপনাকে আপনার সার্টিফিকেট গুলো থেকে, যেখানে শিক্ষাযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি রয়েছে – অনেক বেশি এগিয়ে রাখবে। আর আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গী খুঁজে পাবেন। আসলে আপনাকে খুঁজতেও হবে না, সে ই আপনাকে খুঁজে বের করবে। বিষয়টি বুঝে রাখুন। এটাই এই আয়াতের চমৎকার একটি মর্মার্থ। সে আপনাকে খুঁজে বের করবে ৷ আর তাঁর বাবার কাছে আপনার জন্য অনুরোধ ও করবে, আপনার কিছুই করতে হবে না। শুধুমাত্র আপনাকে চরিত্রবান একজন মানুষ হতে হবে। সুবহানাল্লাহ ।
শুধু একটি ঘটনা – একটার পর একটা শিক্ষা, একের পর এক শিক্ষা এটির গভীরে অন্তর্নিহিত। এগুলোর পরেও আমার প্রিয় একটি শিক্ষা যা এই আয়াত থেকে পাওয়া যায় – দেখুন, মেয়েদের আব্বা অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, বয়স্ক অভিজ্ঞ ছিলেন। মুসা আলাইহিস সালাম বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন – আল্লাহ ওনাকে হিকমাহ ইতিমধ্যেই দিয়ে রেখেছেন, প্রজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন। আল্লাহ বলেন –
ولما بلغ اشده اتيناه حكما وعلما
আল্লাহ তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করে ছিলেন। সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আর যেকোন জ্ঞানী মানুষ এটি বুঝতে পারে যে তাঁর কার দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত আর কার দিকে নয়। তো যখন মুসা তাঁর সাথে দেখা করলেন, তাঁর কাছে সব খুলে বললেন, নিজের সব কাহিনী তাকে জানালেন কেননা তিনি অনুভব করছিলেন যে এই মানুষটি জ্ঞানী- আমাকে উপদেশ দিয়ে সাহায্য করতে পারে, তাই তাঁর কাছে সব খুলে বলা উচিত, এই সুযোগ আর নাও পেতে পারি। অর্থ্যাৎ তাদের পিতা জ্ঞানী মানুষ ছিলেন।
আপনি যদি জ্ঞানীও হন, বৃদ্ধ হন, অভিজ্ঞ হন, অনেক বেশি জানেন – তারপরেও হতে পারে যে আপনার সামনে বড় কোন সুযোগ আসবে যা আপনি হারিয়ে বসবেন। আর আপনার নিজ কন্যা যে কিনা আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট, অভিজ্ঞতায় অনেক পিছিয়ে, জ্ঞানও আপনার থেকে অনেক কম – আপনার সামনে এমন কিছু নিয়ে আসতে পারে, আপনাকে এমন কোন বিষয়ে অবগত করতে পারে যা কিনা আপনার পরিবারের সকল সমস্যার সমাধান ঘটয়ে দিতে পারবে। আর আপনি সেটা লক্ষ্যই করেননি। আপনার বয়স বেশি, আপনি প্রাজ্ঞ, অনেক বেশি জানেন, অভিজ্ঞতা বেশি – তার মানে এই না যে আপনার সবকিছুই সঠিক হবে। সবকিছুর পরেও আপনি একজন মানুষ এবং সবকিছুর পরও আপনার উপদেশ বা পরামর্শের প্রয়োজন হতে পারে ৷ আর শুধুমাত্র – কেউ আপনার থেকে ছোট, বিশেষ করে এমন কেউ যে আপনার সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করে, আপনার নিজ সন্তান – যদি আপনাকে পরামর্শ দেয়, সেটা উড়িয়ে দেয়ার জন্য এগুলো কোন কারন নয়। আপনার সেটাকে উপদেশ হিসেবেই নেয়া উচিত।
এই আয়াতের মধ্যে তরুনদের জন্য, কন্যাদের জন্য উপদেশ আছে । মা-বাবাদের জন্য উপদেশ আছে। এমন পুরুষের জন্য উপদেশ রয়েছে যারা বিয়ে করতে আগ্রহী। আর এ সকল কিছু , “আব্বা, তাকে কাজের জন্য নিন” এতটুকুর ভিতর। শুধুমাত্র এই বাক্যাংশটির ভেতর, আব্বা তাকে নিয়ে নিন। ইতিহাস পালটে গেল, এই মানুষটির ক্যারিয়ার, তাঁর জীবনের পরবর্তী আট থেকে দশ বছর, ফিরাউনের সাথে তার অবিশ্বাস্য সব মোকাবেলা, যে পরিবারের সাথে তিনি হেটে তিনি পাহাড়ে চড়েন – সবকিছু ঠিক হয়ে যায় ওই ছোট কথপোকথনে। সব হয় কারন সেই নারীটি এই পরামর্শ ইঙ্গিতাকারে দিয়ে দেয় । তাই উত্তম কোন পরামর্শকে কখনো ছোট করে দেখবেন না। ছোট করে দেখবেন না, কারন গর্বের কারনে আপনি উত্তম কোন উপদেশ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন – আমি এই উপদেশ মানবো না কারন এটা তোমার থেকে আসছে। কিভাবে আমার মত অভিজ্ঞ, জ্ঞানী কোন মানুষ তোমার কথা শুনতে পারে? বরং তোমার উচিত আমার কথা শোনা। যদি এই গর্ব আপনাকে পেয়ে বসে, সম্ভাবনা বেশি যে আপনি আগামীতে খুবই উত্তম, ভাল কিছু হারাতে যাচ্ছেন। আপনারা কী ভাবতে পারেন মুসা আলাইহিস সালাম তাঁর পরের জীবনে কি পরিমান উত্তম কর্মসাধন করেন ? – সে সকল বছরের দরুন যেগুলো তাঁর গঠনমূলক সময় ছিল বলা যায়, সেই বিবাহ, সেই পশুপালন, সেই আশ্রয় যা তিনি পেয়েছিলেন। সমস্ত ভাল কাজ যা তিনি করেছেন, কার্যত যতবার আমরা তাঁর নাম স্মরণ করি – জানেন সেখান থেকে কে কিছুটা অংশ পায় ? – সেই পিতা যিনি নিজের মেয়েকে তাঁর সাথে বিবাহ করাতে সিদ্ধান্ত নেন । আর কে সেখান থেকে অংশ পায় ? – সেই মেয়ে, সে নারী যিনি তাঁকে বিয়ে করতে আগ্রহী হন আর নিজ ইচ্ছা জানাবার সৎ সাহস রাখেন এবং বলেন, আমার মনে হয় আপনার তাকে কাজে নেয়া উচিত।