তিনি যেমন পৃথিবী দেখতে চেয়েছিলেন – ইসলাম ও বর্ণবাদ

ইসলাম আবির্ভাবের ১০০ বছরের মাঝে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করলো আফ্রিকা, পারস্য, ভারত এবং স্পেন পর্যন্ত। ইসলামিক সভ্যতার আগমনই ঘটত না, সমৃদ্ধি তো দূরের কথা, বিভিন্ন গোষ্ঠীর এবং সংস্কৃতির অহমিকার কারণে। এটা সম্ভব হয়েছিলো নবী (স) এর শক্তিশালী বাণীর আগমনে, যার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মানুষ সম্প্রীতির সাথে বাস করতে পেরেছিলো, ইসলামের ছায়াতলে।

ইতিহাসবেত্তা এইচ.আর.গিব লিখেছেন, অন্য কোনো সমাজে এমন সাফল্যের দৃষ্টান্ত নেই যেখানে এত বেশি সংখ্যক সামাজিক অবস্থান, সুযোগ-সুবিধা ও অসংখ্য জাতি ও বর্ণের মানুষদের প্রচেষ্টা একীভূত হয়েছিলো।

ইসলামের শক্তির সাহায্যে এখনও নিষ্পত্তি ঘটানো সম্ভব বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির আপাতদৃষ্টিতে নিরাময়ের অযোগ্য উপাদানের।তবে এই পরিবর্তন রাতারাতি হয়নি, বরং আজীবন নবী (স) এর সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিলো গোষ্ঠী, বর্ণ ও বিভিন্ন শ্রেনীর মাঝে ভেদাভেদ উচ্ছেদ করা। তিনি শুধু দাস মুক্ত করেননি, তিনি তাদের সম্মান দিয়েছিলেন এবং তাদের পক্ষ হয়ে সমাজের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। আর ২০ বছরেরও কম সময়ে তিনি সফল হয়েছিলেন নারী ও পুরুষকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদানে যারা সারা জীবন অপদস্থ হয়েছিলো পূর্ববর্তী ক্ষমতাশীলদের দ্বারা। এ ঘটনা ঘটেছিলো ১৪০০ বছর আগে, আরবের মরুভূমিতে। আমরা যে সমাজে বাস করি তার থেকে একেবারেই আলাদা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চেয়ে উন্নত। আর সত্যিটা স্বীকার করতেই হবে, আমাদের তাদের থেকে অনেক কিছু শিখার আছে। কারণ আমরা যদিও এই কয়েক বছরে অনেক অগ্রসর হয়েছি, বর্ণবাদ আজকের দিনেও প্রায়ই এর কুৎসিত মাথা তুলে দাঁড়ায়। আমাদের দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা যখন এমন ঘটে আমরা এর বিরুদ্ধে দৃঢ় ভাবে রুখে দাঁড়াবো।

আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, যারা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে তারা নিজেরা স্বাধীন হওয়ার যোগ্য নয়। গৃহযুদ্ধ হয়েছিলো এই দেশে কেবল দেড়’শ বছর আগে কারণ দাস-দাসীরা স্বাধীনতার পিছে ছুটেছিলো। আর তখনও তাদেরকেই যুদ্ধের প্রথম সারিতে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিলো। যদিও পলিটিকাল এজেন্ডার পিছে অল্প কিছু মানুষ ছিলেন যারা সত্যিই সহানুভূতিশীল ছিলেন দাস-দাসীর ব্যাপারে। সাহসী নারী ও পুরুষেরা মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু অন্তরের দাসত্ব কে ভেঙ্গে ফেলা খুব একটা সহজ কাজ ছিলো না। যেমনটা হ্যারিয়েট টাবম্যান বলেছেন, আমি এক হাজার দাসীকে মুক্ত করেছি, কিন্তু আরও হাজার খানেক মুক্ত করতে পারতাম যদি তারা জানত যে তারা দাসত্ব করছে।

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, স্বাধীনতা অর্জনের কোনো সহজ রাস্তা নেই, কোথাও নেই। শুধু নিজের অবস্থানের উন্নয়ন করার তাগিদ থাকাটা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সাহসিকতা এই দাবি করার যে, প্রত্যেক নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করতে হবে, আর এটা সারা মানবজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।যেমন ম্যান্ডেলা বলেছেন, আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করবে না যতক্ষণ না ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করবে। তবে স্বাধীনতার এই দাবি আদায়ে সব সময় সংঘর্ষের প্রয়োজন নেই, কারণ পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়া সম্ভব শান্তিপূর্ণ উপায়ে, গান্ধী বলেছেন।গত একশ বছরে এমন বর্ণবাদ, জাতিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সংখ্যার অভাব নেই যা এই পন্থা অবলম্বন করেছিলো। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন, আঁধার কে আঁধার দূর করতে পারে না, শুধুমাত্র আলো তা করতে পারে। ঘৃণা কে ঘৃণা ঘুচাতে পারে না, শুধুমাত্র ভালোবাসা তা করতে পারে। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে পূর্ববর্তী দাসদের এবং তাদের মালিকদের ছেলেরা একসাথে ভ্রাতৃত্বের টেবিলে বসবে। তার চার সন্তান এমন এক দেশে বাস করবে যেখানে তাদের গায়ের রঙ দিয়ে বিচার করা হবে না বরং চরিত্র দিয়ে বিচার করা হবে।

ম্যালকম, তার জীবনের অধিকাংশ সময় জুড়ে ভেবেছিলেন বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব গড়া সম্ভব নয়, বলতেন, আমি বিশ্বাস করি সকল মানুষের ভ্রাতৃত্বে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না তার অপচয়ে এমন কারও উপর যে ভ্রাতৃত্বের চর্চা করতে ইচ্ছুক নয়। ভ্রাতৃত্ব দুমুখো পথ, তিনি বলেন। কিন্তু যখন তিনি হজ্জ্ব করতে গিয়েছিলেন মক্কায়, তিনি উপলব্ধি করলেন নবীজি (স) এর বিশ্বজনীন আহ্বানের মধ্য দিয়ে সকল মানুষকে একতাবদ্ধ করা সম্ভব। “আমেরিকার ইসলাম ধর্মকে বুঝতে হবে, কারণ এটা একমাত্র ধর্ম যা সমাজ থেকে বর্ণবাদের সমস্যা মুছে ফেলতে পারে। মুসলিম বিশ্বে আমার ভ্রমণকালে আমি দেখা করেছি, কথা বলেছি, একসাথে বসে খেয়েছি এমন মানুষের সাথে যাদের আমেরিকাও সাদা মানুষ বলবে, কিন্তু সেই ‘সাদা’ আচরণ তাদের মন থেকে মুছে ফেলা হয়েছে ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে। “

ম্যালকম উপলব্ধি করেছিলেন নিরহঙ্কার হওয়ার শক্তি। এর মানে এই না যে আপনি নিজেকে ছোট ভাববেন। যেভাবে ম্যালকম বলেন, তুমি গাছের শিকড় কে ঘৃণা করতে পারো না, গাছটাকে ঘৃণা না করে। তাই নিজের দেশ নিজের শিকড় কে ভালোবাসা জরুরি কিন্তু সমস্যা বর্ণবাদ নিয়ে। যেখানে একজন নিজেকে জন্মগতভাবে অন্যের চেয়ে উচ্চ মনে করে কারণ তাকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। একজন সত্যিকারের মহৎ নেতার প্রথম পরীক্ষা যদি হয় তার বিনম্রতা, তবে নবী (স) পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো নেতা। তিনি ঐতিহ্যবাহী বংশে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর আবির্ভূত হওয়া, তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে পাওয়া আনুগত্য যা অন্য কোনো রাজা কিংবা নেতা কখনো উপলব্ধি করেনি ইত্যাদির পরেও তিনি সামান্য এক বাড়িতে থাকতেন, খড়কুটার বিছানায় ঘুমাতেন, তাঁর অনুসারীদের মতন কাপড় পড়তেন, তাঁদের সঙ্গে একই সাথে বসতেন, এতটা সাধারণভাবে যে, একজন বিদেশী দূত এসে তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারতো না। তিনি পূর্বের দাস কিংবা নেতাদের সাথে ছিলেন কিনা সেটা ভাবার বিষয় নয় বরং তাঁর স্বপ্ন ছিলো এমন পৃথিবী দেখার যেখানে এসবের কেউ পরোয়া করে না। রাসূলুল্লাহ (স) এর স্বপ্ন কে বুঝতে হলে আমাদের নিজেদের কুসংস্কার কে প্রশ্ন করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে প্রত্যেক পর্যায়ের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে।

খুব সহজ সাম্যের ব্যাপারে পড়াশুনা করা, লেকচার দেওয়া কিংবা কথা বলা কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এর বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। গতকাল আমি আমার বহু পুরানো এক বন্ধুর সাথে পার্কে বসেছিলাম আর তার সন্তানদের খেলতে দেখছিলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম তার বড় ছেলে প্রতিবেশী এক দেশের ছেলে যাকে সে দত্তক নিয়েছে। আমি বললাম আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি। আর আমি প্রশংসা করলাম যে সে তার অন্য সন্তানের মতই সবসময় তার সাথে ব্যবহার করেছে। সে বলল নবীজী (স) এর দ্বারা সে অনুপ্রাণিত হয়েছে। যিনি যায়িদ ইবন হারিসা (রা) কে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং এতটা যত্ন নিয়েছেন যে, যখন যায়িদ এর পিতা তাঁকে অনেক বছর পর খুঁজে পেল তিনি তখনো নবী (স) এর সাথে থাকতে চাইলেন।

“পশ্চিমা সভ্যতার অতি-উৎসাহী মিথ্যা যেগুলো এই ব্যক্তি (মুহাম্মাদ) এর চারপাশে স্তূপ করা হয়েছে তা কেবল আমাদের জন্য লজ্জাজনক। কিভাবে একজন মানুষ এক হাতে যুদ্ধরত গোত্র এবং যাযাবর বেদুঈন দের একত্রিত করে অন্যতম শক্তিশালী এবং সভ্য জাতিতে রূপান্তরিত করেছেন দুই দশকেরও কম সময়ে…এক মহান প্রেরণাদাতা, যিনি কেবলই আন্তরিক, তাঁর দায়িত্ব ছিলো পৃথিবীকে জাগ্রত করা, স্রষ্টা যা আদেশ করেছিলেন।” – থমাস কারলাইল