জিব্রাইল (আঃ) এর গল্প (৪র্থ পর্ব)

খাদিজা (রা) বললেন – চলুন, ওয়ারাকার কাছে যাই। তো, তাঁরা তার নিকট গেলেন। রাসূল (সঃ) যা দেখলেন তা ওয়ারাকার নিকট বর্ণনা করলেন। ওয়ারাকা সাথে সাথে বলে উঠলেন – ”ইনি নামুস! (আপনিই সেই রাসূল যার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।) এই ফেরেশতাই (নামুস বা জিব্রিল) মূসার (আঃ) কাছে এসেছিলেন। ইস! আমি যদি যুবক হতাম! তাহলে আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম! যখন আপনার সম্প্রদায় আপনার বিরোধিতা করবে।”

এরপর কি ঘটেছিল? আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন – এরপর বহুদিন যাবত ওহী অবতীর্ণ হওয়া বন্ধ থাকে। রাসূল (সঃ) অপেক্ষা করতে লাগলেন যেন সেই ফেরেশতা আবার দেখা দেন। রাসূল (সঃ) আবার ওইসব পাহাড়ে ঘুরতে লাগলেন। রাসূল (সঃ) নিজের ভাষায় তা এভাবে বর্ণনা করেন যে, ”(তাঁর মানসিক অবস্থা এমন ছিল যে) তিনি যেন চাইতেন নিজেকে পাহাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে!” তিনি স্পষ্টরূপে জানতে চান কি ঘটছে! প্রতিবার রাসূল (সঃ) পাহাড়ে গেলে জিব্রিল (আঃ) এর কণ্ঠ শুনতে পেতেন। ”ও মুহাম্মাদ! আপনি আল্লাহর সত্য রাসূল।” এতে রাসূল (সঃ) কিছুটা সান্ত্বনা পেতেন এবং ঘরে ফিরে আসতেন।

এরপর পরবর্তীতে তিনি শুধু যে ”ও মুহাম্মাদ! আপনি আল্লাহর সত্য রাসূল।” এ কথা বলতেন তা নয়, তিনি আরও বলতেন – ”আর আমি জিব্রিল”। তো, তিনি রাসূল (সঃ) এর নিকট বিষয়টা পরিষ্কার করলেন যে তিনি জিব্রিল (আঃ)। কিন্তু তবু কোন কুরআন বা ওহী অবতীর্ণ হয়নি। অবশেষে, অন্য একদিন রাসূল (সঃ) হাঁটছিলেন – আর এবার ‘ইয়া মুহাম্মাদ ইন্নাকা রাসূলুল্লাহি হাক্কা’- ”ও মুহাম্মাদ! আপনি আল্লাহর সত্য রাসূল” এ বাক্য নয়। বুখারি শরীফে জাবির (রা) থেকে বর্ণিত আছে- রাসূল (সঃ) হাঁটছিলেন তারপর হঠাৎ উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন – জিব্রিল আলাইহিস সালাম তাঁর পরিপূর্ণ ফেরেশতার আকৃতি ধারণ করে সম্পূর্ণ আকাশ ঢেকে আছেন, সম্পূর্ণ দিগন্তকে ঢেকে আছেন।

আল্লাহ জিব্রিল (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন – ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَىٰ প্রজ্ঞার অধিকারী, সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল। জিব্রিল (আঃ) পুরো আকাশ জুড়ে আবির্ভূত হলেন। রাসূল (সঃ) জিব্রিল (আঃ) কে তাঁর সকল ডানা সমেত, পরিপূর্ণ আকৃতিতে দেখতে পেলেন। ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ তিনি রাসূল (সঃ) এর নিকটবর্তী হতে লাগলেন। তিনি রাসূল (সঃ) থেকে মাত্র দুই ধনুকের দূরত্বে ছিলেন। তিনি রাসূল (সঃ) এর কাছাকাছি আসলেন। রাসূল (সঃ) জমিনে পড়ে গেলেন। তিনি নিজেই বলেছেন যে – ”তিনি আমার অতি নিকটবর্তী হওয়াতে আমি এত ভয় পেয়েছিলাম যে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম।”

রাসূল (সঃ) দ্রুত বাড়িতে ফিরে গেলেন আর খাদিজা (রা) কে বলতে লাগলেন – আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও। আর ঠিক তখন পরবর্তী ওহী অবতীর্ণ হয় – يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ – قُمْ فَأَنذِرْ – وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ – وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ

হে চাদরাবৃত! উঠুন, সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষনা করুন, আপন পোশাক পবিত্র করুন। সুবহানাল্লাহ, চিন্তা করে দেখুন, প্রথম ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় তিনি হেরা গুহায় ছিলেন আর দ্বিতীয়বার তিনি যখন খাদিজা (রা) কাছে ছিলেন তখন ওহী অবতীর্ণ হয়। ”হে চাদরাবৃত! উঠুন, সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষনা করুন, আপন পোশাক পবিত্র করুন।” মূর্তি পরিত্যাগ করুন। এই হলো প্রথমদিকের ওহী অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা। আয়েশা (রা) বলেন- এর পর থেকে একটির পর একটি ওহী অবতীর্ণ হতে থাকে। অর্থাৎ দীর্ঘ বিরতির পর আসে সূরা মুদ্দাসসির, সূরা মুজ্জাম্মিল, সূরা দোহা এবং আরও অনেক সূরা ক্রমাগত রাসূল (সঃ) এর নিকট অবতীর্ণ হতে থাকে। এভাবেই শুরু।

রাসূল (সঃ) এখন বুঝতে পারলেন কি ঘটছে, তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি আল্লাহর রাসূল। রাসূল (সঃ) এখন আর জিব্রিল (আ) এর উপস্থিতিকে ভয় পান না। বিষয়টা তাঁর (সঃ) কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

জিব্রীল (আ) এবং রাসূল (সঃ) এর মাঝে ব্যক্তিগত কথোপকথন। জিব্রিল (আঃ) রাসূল (সঃ) এর ঘরে বহুবার এসেছিলেন, তাঁর সাথে কথা বলতেন। বিভিন্ন সময় কোন কোন সাহাবী তাঁকে দেখতে পেতেন আবার কেউ কেউ দেখতে পেতেন না। একদিন আব্বাস (রা) তার সন্তান আব্দুল্লাহ (রা) কে নিয়ে রাসূল (সঃ) এর সাথে সাক্ষাত করতে আসেন। আব্বাস (রা) রাসূল (সঃ) কে সম্বোধন করে কথা বলছিলেন, কিন্তু তিনি সাড়া দিচ্ছিলেন না। রাসূল (সঃ) কোন কথা না বলাতে আব্বাস (রা) চলে যান। চলার পথে আব্বাস (রা) আব্দুল্লাহ (রা) কে বললেন, তোমার চাচাতো ভাই কেন আমার সাথে কথা বলল না। তিনি মনে হয়ে যেন আমাকে দূরে ঠেলে দিলেন! আব্দুল্লাহ (রা) বললেন – আপনি কি দেখেন নি যে রাসূল (সঃ) তাঁর সামনে বসা এক লোকের সাথে কথা বলছিলেন। আব্বাস (রা) বললেন- কোন মানুষ? আমি তো কাউকে দেখলাম না। তো, আব্বাস (রা) আবার রাসূল (সঃ) এর কাছে ফিরে আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন- তখন কেউ কি আপনার সাথে কথা বলছিল? রাসূল (সঃ) বললেন- আপনি কেন এটা জিজ্ঞেস করছেন? আব্বাস (রা) বললেন- কারণ আব্দুল্লাহ তাঁকে দেখতে পেয়েছিল। রাসূল (সঃ) বললেন- ‘রাআ’- সে দেখেছে? আব্বাস (রা) বললেন- জী, দেখেছি। তারপর রাসূল (সঃ) আব্দুল্লাহ (রা) এর জন্য দোয়া করেন যেন আল্লাহ তাঁর জ্ঞান বাড়িয়ে দেন।

তো, রাসূল (সঃ) এর সাথে জিব্রিলের ব্যক্তিগত কথোপকথন টা কেমন ছিল? রাসূল (সঃ) জিব্রিল (আ) কে বললেন – আল্লাহ বলেছেন যে – আমি আপনাকে (রাসূল সঃ কে) সকল জগতবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- আমার রহমতের কোন অংশ কি আপনার পর্যন্ত পৌঁছেছে? মানে, আপনিও তো জগতের অংশ, আপনি ফেরেশতাদের জগত থেকে, কোন রহমা কি আপনার পর্যন্ত পৌঁছেছে? জবাবে জিব্রিল (আ) বললেন- ”আল্লাহর শপথ! ও মুহাম্মাদ! আপনি আমার সবচেয়ে প্রিয় নবী।” মানে, আমাকে আজ পর্যন্ত এমন কারো কাছে পাঠানো হয়নি, যাকে আমি আপনার থেকে বেশি ভালবাসি। তিনি আরও বললেন- ”আপনার মাধ্যমেই আমি নিরাপত্তা লাভ করেছি।” এটা দ্বারা তিনি আসলে কি বুঝালেন? তিনি বললেন- আমি আমার ভাগ্য নিয়ে চিন্তায় থাকতাম, যতক্ষণ না আপনার নিকট এই আয়াত অবতীর্ণ হলো – ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ – যে শক্তিশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন, প্রতিষ্ঠিত। secure [in position]।

জিব্রিল (আঃ) রাসূল (সঃ) কে ক্রমাগত আশ্বস্ত করতে লাগলেন। মাদানী জীবনের অনেক ব্যক্তিগত আলোচনায় জিব্রিল (আঃ) বারবার রাসূল (সঃ) কে আশ্বস্ত করার ব্যাপারটা দেখা যায়। কেন? কারণ, দেখুন, রাসূল (সঃ) জানলেন যে, তিনি এবং বিশ্বাসীরা নিরাপদ। কিন্তু রাসূল (সঃ) এখন কাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন? আমাদের নিয়ে – যারা পরবর্তীতে আসবে। তাই তিনি উম্মাতি, উম্মাতি বলে কাঁদতেন। তাই, আল্লাহ জিব্রিল (আঃ) কে পাঠালেন। জিব্রিল (আঃ) বললেন- ইয়া, মুহাম্মাদ! আমরা আপনার উম্মাতের বিষয়ে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দিব, আমরা আপনাকে হতাশ করবো না। আপনার উম্মত ঠিক থাকবে।

তিনি মদিনায় রাসূল (সঃ) কে বার বার নিশ্চয়তা দিতেন। কারণ রাসূল (সঃ) পরবর্তীতে আসা উম্মাত নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। সাহাবীরা নিরাপদ। কিন্তু যারা পরবর্তীতে আসবে তাদের কি হবে? আরেকবার, ওমার (রা) বলেন, আর এটা বুখারিতে বর্ণিত আছে- আমি একবার মদিনাতে রাসূল (সঃ) এর সাথে হাঁটছিলাম, হাঁটতে হাঁটতে আমরা মদিনার ‘হাররা’ নামক এক জায়গায় উপস্থিত হলাম। তিনি আমাকে এখানে বসতে বললেন। হঠাৎ তিনি হাঁটতে লাগলেন, আর তখন স্পষ্টত তিনি জিব্রিল (আ) এর সাথে কথা বলছিলেন। আমি আপনাদের বলতে পারি তিনি জিব্রিল (আঃ) এর সাথে কথা বলছিলেন। তারা কিছুক্ষণের জন্য হাঁটলেন আর আমি বসে থাকলাম। আর এই হাটাবস্থায় রাসূল (সঃ) বলছেন- ‘ও ইন যানা ওয়া সারাক’ ‘ও ইন যানা ওয়া সারাক’ ‘ও ইন যানা ওয়া সারাক’ এমনকি যদি সে জিনা করে বা চুরি করে? এমনকি যদি সে জিনা করে বা চুরি করে? আর ওমর (রা) উত্তর শুনতে পাচ্ছিলেন না। তো, ওমর (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ঐটা কি ছিল? রাসূল (সঃ) বললেন, তিনি ছিলেন জিব্রিল (আঃ)। তিনি এসেছিলেন আমাকে সুসংবাদ দিতে যে, এই উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তি অবশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাই রাসূল (সঃ) বললেন, এমনকি যদি সে জিনা করে বা চুরি করে? – হ্যাঁ, এমনকি যদি জিনা বা চুরি করে। অবশেষে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তো, তিনি রাসূল (সঃ) কে এভাবে সান্ত্বনা দিলেন।