অন্তর এবং বুদ্ধির সম্পর্ক

আমাদের ধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো অন্তর এবং বুদ্ধির সম্পর্ক। যখন আল্লাহ বলেন – ‘লাআল্লাকুম তা’কিলুন’, যেন তোমরা চিন্তা করতে পারো’… তিনি এখানে ‘আকল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

‘আকল’ এর অবস্থান আপনার মস্তিষ্কে। আরবিতে ‘আকালা’ শব্দের অর্থ হলো – বুঝতে পারা। এর আরেকটি অর্থ হলো – কোনো কিছু বাঁধা। তাহলে ‘আকালা’ দ্বারা দুইটি বিষয় বোঝায় – বুঝতে পারা এবং কোনো কিছুকে শৃঙ্খলিত করা।

যখন আমরা কোনো কারণে মানসিকভাবে অভিভূত হয়ে পড়ি, আমরা ভালোভাবে চিন্তা করতে পারি না। যদি আপনি অতিমাত্রায় রাগান্বিত হয়ে পড়েন, আপনি চিন্তা ভাবনা ছাড়াই অনেক কিছু বলে ফেলেন। যদি কোনো কিছুতে চরম খুশি হয়ে পড়েন, তাহলেও চিন্তা ভাবনা ছাড়া কিছু একটা করে ফেলেন। যদি অতিশয় দুঃখিত হয়ে পড়েন, তখনও চিন্তা ভাবনা ছাড়া কাজ করে ফেলেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে কখনো কখনো আবেগ আপনাকে সঠিকভাবে চিন্তা ভাবনা করতে বিরত রাখে। এখন, আকল এর কাজ হলো আপনার আবেগকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেন আপনি সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারেন। তাই, আকল অর্থ শুধু বুঝতে পারা নয়, এর অর্থ হলো – প্রথমে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং তারপর বুঝতে পারা। ঘৃণা, রাগ, ভয় এ ধরণের মানবীয় আবেগের প্রভাবমুক্ত হয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারার নামই হলো আকল।

অনেক সময় দেখা যায়, আপনি যদি কাউকে ঘৃণা করেন সে সঠিক কথা বললেও আপনি তা মানতে চান না। বনী ইসরাইলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের নিকট সকল প্রমান উপস্থাপন করা সত্ত্বেও তারা রাসূল (স) কে মেনে নিচ্ছিলো না। কারণ তাদের অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। অহংকার তাদের ‘কলব বা অন্তর’ ঢেকে ফেলেছিলো। তাই তাদের বুদ্ধি সকল প্রমান দেখা সত্ত্বেও রাসূল (স) কে স্বীকার করেনি।

“দেখো দেখো তাওরাতেও এ সম্পর্কে বলা হয়েছে…আর কুরআনে বলা হয়েছে
‘মুসাদ্দিকুল লিমা মা’আকুম, এটা তোমাদের নিকট যা নাজিল হয়েছিল তার সত্যতার সাক্ষী দিচ্ছে।’ না, আমি দেখতে চাই না। আমি শুনতেও চাই না।” এভাবে অহংকার তাদের অন্তর দখল করে ফেলেছিলো। তাই তারা ‘আকল’ ব্যবহার করছিলো না; কারণ অন্তর এখন তালাবদ্ধ।

ভয়ের অবস্থান অন্তরে, রাগের অবস্থান অন্তরে, ঘৃণার অবস্থান অন্তরে, সন্দেহের অবস্থান অন্তরে, হিংসার অবস্থান অন্তরে, এভাবে যত ধরণের আবেগজনিত এবং মানসিক ব্যাধি রয়েছে কুরআনের ভাষা অনুযায়ী এ সবগুলো অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পক্ষান্তরে, চিন্তা করা, গবেষণা করা, প্রমান উপস্থাপন করা, বিবেচনা করা, সত্যের খোঁজ করা এসব বিষয় বুদ্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত।

পরিষ্কারভাবে, কুরআনের ভাষা অনুযায় কে ড্রাইভিং সিটে? অন্তর। আপনার অন্তর যদি পরিষ্কার না থাকে, জগতের সকল জ্ঞান-প্রমান আপনার থাকতে পারে, কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আল্লাহ বলছেন – ”তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শণসমূহ প্রদর্শন করেন-যাতে তোমরা তোমাদের ‘আকল’ ব্যবহার করতে পারো।” এর মানে কী? এর মানে হলো, আমি তোমাদেরকে আমার নিদর্শনসমূহ প্রদর্শন করি, কারণ এটা তোমাদের আবেগকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিবে। আর যখন তোমাদের আবেগ সঠিক পথে থাকবে, তোমরা সত্যিকারার্থে চিন্তা করতে পারবে।

কুরআনের অন্যতম একটি মু’জিজা হলো – যখন আপনি এই কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করবেন… এটা একই সময়ে একটি আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজ্ঞতা। এই কুরআন একই সময়ে আপনার অন্তর এবং বুদ্ধিকে আক্রমণ করে। এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার!! এই বই আপনার বোধশক্তির দিগন্তকে সম্প্রসারিত করে তুলবে, আপনি ভিন্ন এক দৃষ্টকোণ থেকে জগৎকে দেখতে শুরু করবেন; আবার একই সময়ে আপনার চোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত হতে শুরু করবে।

[বায়্যিনাহ টিভিতে সূরা বাকারার ২৫ তম পর্বের আলোচনা থেকে]