আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ
“তাদের অন্তঃকরণ ব্যধিগ্রস্ত……” [সূরা আল-বাকারাঃ ১০]
এই আয়াতের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো: আল্লাহ তা’আলা এখানে ‘ফি সুদূরিহিম মারাদুন’ বলেননি, তিনি বলেছেন ‘ফি কুলুবিহীম মারাদুন’। ‘সুদুর’ এবং ‘কুলুব’ এই দুটি শব্দের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য রয়েছে।
আমরা সবাই কম বেশি ‘সূরা নাস’ জানি। যেখানে বলা হয়েছে ”الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ আল্লাজি ইউওয়াস বিসু ফি সুদুরিন নাস — যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের বুকের মধ্যে”।
আমরা কিন্তু সেখানে ‘কুলুবিন নাস’ বলি না। যদি ‘কুলুবিন নাস’ বলা হতো তাহলে সূরা নাসের এই আয়াতের অর্থ হতো ‘সে, যে মানুষের (হার্ট) হৃদয়ের মধ্যে কুমন্ত্রণা দেয়।’ কিন্তু ‘সুদূরিন নাস’ বলার কারণে এইখানে অর্থ হয়ে যাচ্ছে ‘সে, যে মানুষের বুকের মধ্যে কুমন্ত্রণা দেয়।’ এখন আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখবো যে হার্ট এবং বুক এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বুক হচ্ছে একটা ভল্ট এর মত, একটা সুরুক্ষিত জায়গা। আর হার্ট হচ্ছে এই সুরুক্ষিত জায়গার মধ্যে রাখা মূল্যবান বস্তু। এখন, শয়তানের ক্ষমতা হচ্ছে আপনার বুকের মধ্যে প্রবেশ পর্যন্ত। নিজের ক্ষমতাবলে সে আপনার বুকের ভিতরে ঢুকতে পারে। কিন্তু নিজের ক্ষমতাবলে আপনার হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশের ক্ষমতা তার নেই। ব্যাপারটা পরিষ্কারভাবে বুঝার জন্য আপনার হৃদয়কে তুলনা করুন আপনার ঘর এর সাথে, আর বুক হচ্ছে সেই ঘর এর চারপাশে সীমানা প্রাচীর। শয়তান আপনার সেই সীমানা প্রাচীর এর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে কিন্তু যেই পর্যন্ত না আপনি তাকে ঘর এর দরজা খুলে ভিতরে আসতে দিচ্ছেন, ততক্ষণ সে আপনার ঘরের ভিতরে ঢুকতে পারবে না। অর্থাৎ আপনার হৃদয়ের বাইরে শয়তান বসে আছে, এবং আপনার হৃদয়ের বন্ধ দরজায় সে অবিরাম করাঘাত করে যাচ্ছে, বিভিন্ন উপায়ে আপনাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে (লোভনীয় অফার এর কথা বলে) দরজা খোলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আমাদেরকে শয়তানের এই কুমন্ত্রণা অনুভব করে সাবধানে থাকতে হবে যেন সে কোনভাবেই ভেতরে আসতে না পারে। শয়তান কিন্তু খুবই নিকটে, আপনার হৃদয়ের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে, আপনাকে অবিরামভাবে দরজা খোলার জন্য প্ররোচিত করে যাচ্ছে। আচ্ছা বলুন তো, কেউ যখন দরজার বাইরে থেকে দরজা খোলার জন্য অনুরোধ করে এবং করাঘাত করে তখন কি সেটা ভেতর থেকে শোনা যায়? … অবশ্যই শোনা যাবে, তাই না? তখন আমরা কি করি? পরিচিত কেউ হলে অথবা অপরিচিত কেউ যদি সন্তোষজনকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে তাহলে আমরা দরজা খুলে দেই। অন্যথায় দরজা না খুলে ঐ ব্যক্তিকে চলে যেতে বলি।
একইভাবে শয়তানের ধোকাবাজিতে পড়ে আমরা যদি দরজা খুলে দেই তাহলে কি হবে? শয়তান ভিতরে ঢুকে পড়বে! আর যখনি বাইরের কেউ আপনার মনের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়বে, তখনি সে তার নিজের মতো করে আপনার ঘর সাজাতে শুরু করবে। যতক্ষণ আপনি একা আপনার মনের ঘরের কর্তা ছিলেন, আপনি নিজের মতো করেই আপনার ঘর সাজিয়ে রেখেছেন। আপনার কাছে কোনটা ভালো বা কোনটা খারাপ তার একটা নির্দিষ্ট ছক ছিল। দেয়ালের রং কেমন হবে, ফার্নিচারগুলো কিরকম হবে, এইসব আপনি আপনার মনের মতো করে ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু যেই আপনার মনের ঘরে আপনি অনাহূত (খারাপ) কাউকে থাকতে দিবেন, কিছুদিন পরে এসে আপনি দেখবেন যে সব উল্টা পাল্টা হয়ে গেছে। রান্না ঘর হয়ে গেছে বেডরুম আর টয়লেট হয়ে গেছে গেস্টরুম! আপনি যদি তখন জিজ্ঞাসা করেন যে ‘কি হচ্ছে এসব’? তখন সে উত্তর দেবে ‘আমার কাছে এইরকমই ভালো লাগছে’।
এখানে এইসব কথা বলার উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য হচ্ছে এইটা বুঝানো যে, আপনি যদি শয়তানকে আপনার হৃদয়ের ঘরে ঢুকতে দেন তাহলে যা কিছু সুন্দর ছিল তা নষ্ট হয়ে যাবে আর যেসব জিনিস খারাপ / নিষিদ্ধ ছিল তা সুন্দরে পরিণত হবে। একারণেই আল্লাহ বলেছেন ‘فَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ (সূরা আন নাহল: ৬৩)’ – “শয়তান তাদেরকে তাদের কাজসমূহকে শোভনীয় করে উপস্থাপন করে”। তারমানে যেই পর্যন্ত আপনি শয়তানকে আপনার হৃদয়ে ঢুকতে না দিচ্ছেন, সেই পর্যন্ত শয়তান কোনো খারাপ কাজকে ভালোতে রূপান্তর করে আপনার সামনে উপস্থাপন করতে পারবে না। এখন আপনি যদি শয়তানকে আপনার হৃদয়ে ঢুকতে না দেন, তাহলে আপনার হৃদয়ের মধ্যে কি রয়ে গেলো? … ঈমান! ‘… وَلَٰكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ (সূরা আল হুজরাত: ৭)’ – “তিনি তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন”।
এবার আমরা যদি সূরা বাকারা’র ১০ নম্বর আয়াতে ফিরে যাই: সেখানে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন ‘ফি কুলুবিহীম মারাদুন’ – অর্থাৎ, তাদের হৃদয় রোগাক্রান্ত! যেটা বড় একটা সমস্যা। এখন এটা কিভাবে হলো? আমাদের ঘরে অনাহুত কেউ যদি ঢুকে পড়ে এবং আমরা যদি সেটা বুঝতে পারি, তাহলে আমরা কি করি? সাথে সাথে তাকে বের করে দেই , তাই না? শয়তানের সাথেও আমরা অনেক সময়ই এইটা করি। না বুঝে আমরা প্রায়শঃই শয়তানকে আমাদের হৃদয়ের দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে আসি। কিন্তু যখনি আমরা সেটা টের পাই, সাথে সাথে আমরা ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম’ বলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থণা করে শয়তানকে মন থেকে বের করে দেই। আর এটাই আমাদের করা উচিত। কিন্তু, আমরা যদি শয়তানকে বের করে না দিয়ে তাকে থাকতে দেই। তাহলে সে ধীরে ধীরে আমাদের মনের ঘরকে তার নিজের ইচ্ছা মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিবে, নিজের পছন্দমতো রান্না বান্না করে আমাদের মনের ঘরকে দূষিত করে তুলবে। আর এর ফলশ্রুতিতে আমরা হয়ে পড়ি অসুস্থ। আমাদের অন্তর রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। যদিও আল্লাহ সকল মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছেন শয়তানকে প্রতিহত করার জন্য; আল্লাহ শয়তানকে বলেন: ‘إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ (সূরা আল হিজর: ৪২)’ – অর্থাৎ, “যারা আমার বান্দা, তাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই”। তারমানে শয়তান আপনার অন্তরে জোর করে ঢুকতেও পারবে না এবং জোর করে থাকতে ও পারবে না। আপনি যখনি বলবেন ‘বের হয়ে যাও’, শয়তান বের হয়ে যেতে বাধ্য। এখন আপনি যদি তাকে আপনার অন্তরে ঢুকতে দেন এবং সেখানে থাকতে দেন, এর মানে এই না যে, সে নিজের ক্ষমতাবলে সেখানে অবস্থান করছে। বরং এর মনে হচ্ছে আপনিই তাকে বের করে দেন নি!
আল্লাহ শয়তানকে বিতাড়িত করার জন্য সব ধরনের অস্ত্র আপনাকে দিয়েছেন। ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শয়তানির রাজীম’ পড়ুন, ইস্তেগফার করুন, শয়তান চলে যেতে বাধ্য। কিন্তু আপনি সেটা করছেন না। আর যখন আপনিই শয়তানকে বের করতে চাচ্ছেন না, তখন আল্লাহ তা’আলা বলছেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার মতোই থাকো।’ ‘… فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا … (সূরা বাকারা:১০)’ – ‘আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ আপনি শয়তানের পথে চলতে চান, ঠিক আছে চলতে থাকুন। শয়তানের সব সাঙ্গপাঙ্গকে আপনার অন্তরে বাসা বাঁধতে দিন। ফলশ্রুতিতে তারা আপনার অন্তরকে এমনভাবে সাজাবে যে, এমনকি রমজান মাসে যখন শয়তান বাঁধা অবস্থায় থাকে, তখনও আপনি এমনভাবে চলবেন যেন মনে হবে শয়তানই আপনাকে চালাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে শয়তান কিন্তু সেখানে নেই, কিন্তু সে এমনভাবে সবকিছুকে নিজের মতো করে সাজিয়ে রেখে গেছে যে আপনি নিজের অজান্তেই তার সেই দেখানো পথেই চলছেন। শয়তানের কাজ আপনি নিজেই করছেন।
আপনারা কি কখনো চিন্তা করেছেন যে আল্লাহ তা’আলা কেন বলেছেন যে ‘মানুষ এবং জীনদের মধ্যেও শয়তান রয়েছে’? শয়তান একসময় জীন ছিল সেটা আমরা জানি, কিন্তু শয়তান মানুষ কিভাবে হতে পারে? ব্যাপারটা এরকম যে, যেসব মানুষ শয়তানকে নিজের অন্তরে ঢুকতে দেয় এবং সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে বাসা বাঁধতে দেয়, তারাই শয়তান হয়ে যায়। তারা মানুষ থেকে শয়তানে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সুবাহানআল্লাহ!এইসব মুনাফিকুনদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা’আলা বলেন যে তাদের অন্তর জটিল রোগে আক্রান্ত। তাদের এই রোগ শুধুমাত্র সন্দেহবাতিকগ্রস্ততাই তৈরি করে না, এই রোগ মানুষকে কাপুরুষ এ রূপান্তরিত করে ফেলে। কোরআন নাজিলের সময় মুনাফিকদের যেরকম আচার আচরণ ছিল, এই যুগের মুনাফিকদের ব্যবহার পুরোপুরি সেইরকম নয়। কিন্তু উভয় দলের মধ্যে অনেক সামঞ্জস্য আছে।
এই যুগে ও তিন ধরনের মানুষ পাওয়া যাবে, ইসলাম সম্পর্কে যাদের ধ্যান-ধারণা ভিন্ন ভিন্ন। এক ধরনের লোকেরা অত্যন্ত গভীরভাবে এইটা মেনে নেয় যে ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (স:) আল্লাহর রাসূল’ এবং তারা মুসলিম হতে পেরে গর্ভ অনুভব করে, নিজেদেরকে সম্মানিত মনে করে। আল্লাহ এবং তার রাসূলের নির্দেশ তাদের কাছে সবসময় অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে অনেক উপরে। তারা সবসময় মনে প্রাণে এইটা বিশ্বাস করে যে আল্লাহর দ্বীন নিখুঁত। মানুষ হিসেবে আমরা ভুল করতে পারি, আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন সকল সমালোচনার উর্দ্ধে। এই ধ্যান ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতে আরেক দল লোক আছে যারা ইসলাম এবং মুসলিমদের তীব্রভাবে ঘৃণা করে।
আর এই দুইদলের মাঝখানে আরেক ধরনের কিছু মানুষ আছে যারা মনে করে ‘কোরআনের সবকিছু এতো কঠোরভাবে মেনে চলার কি দরকার? কিছুটা সমঝোতা তো করাই যায়, হাজার হলেও এখন ২০১৬ সাল। সময়ের সাথে কিছু কিছু ব্যাপারে একটু ছাড় তো দেয়াই যায়। কোরআনের সবকিছু যদি এই যুগে হুবহু মেনে চলতে যাই তাহলে তো ব্যাপারটা বেশি কঠোরতার দিকে চলে যায়। আমাদের দুইদিকেই ভারসাম্য রেখে চলা উচিত’। এই দলের মানুষেরা আর কিছুই নয়, এরা হচ্ছে মহানবীর (স:) আমলের সেই মুনাফিকদেরই আরেকটা রূপ। আমাদের দ্বীন নাজিল হওয়ার সময় থেকেই ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এটাকে নতুন করে ভারসাম্যপূর্ণ করার কিছু নেই! স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এই দ্বীনকে দুনিয়া এবং আখিরাতের সাথে সর্বোচ্চ উপায়ে সমতা সাধন করেই আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। এখানে আপনার বা আমার এইটা বলার কোন সুযোগ নাই যে ‘আমাদেরকে আসলে ইসলামের কিছু ব্যাপারে সমতা সাধন করা দরকার।’ নিজের ভিতরের ভয়, কাপুরুষতা থেকেই এইধরণের ধারণা আমাদের মধ্যে জন্মলাভ করে। অন্যের সামনে নিজেকে হাস্যকর মনে হবে, অন্যেরা আমাকে নিয়ে কি ভাববে? সমাজে আমার অবস্থান কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে? এইসব চিন্তাভাবনার কুপ্রভাব যেয়ে পড়ে আমাদের ইসলামের প্রতি বিশ্বাসের উপরে। তাই আমরা যখন এইসব নিয়ে পড়ালেখা করবো তখন আমাদের নিজেদেরকে নিয়েও চিন্তা করতে হবে, ভেবে দেখতে হবে যে আমি আসলে কোন দলের মধ্যে পড়ি? ইসলাম নিয়ে আমার নিজের চিন্তাভাবনা ঠিক পথে আছে তো?