মানসিক শান্তির সন্ধানে

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

[উস্তাদ নুমান আলী খানের কুর’আনিক জেমস (Quranic Gems) সিরিজের ঊনত্রিশতম পর্বের বাংলা ভাবার্থ। দ্রুত অনুবাদ করার কারণে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকাটা স্বাভাবিক। আমার এই অনিচ্ছাকৃত ভুল আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যা কিছু কল্যাণকর তার সম্পূর্ণই আল্লাহ্‌র তরফ থেকে, আর যা কিছু ভুল সেটি সম্পূর্ণ আমার। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন আমার সেই ভুলগুলো মার্জনা করুন। তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। আল্লাহ্‌তালা আমাদের সকলকে কুর’আনের আয়াতসমূহ বুঝে পড়ার তৌফিক দান করুন এবং সঠিক মর্মার্থ বুঝে সেই ভাবে জীবনকে পরিচালিত করার মত হিকমাহ, সাহস ও ধৈর্য দিক। আমিন।]

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র; যিনি এই বিশ্বগজতের প্রতিপালক। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর বার্তাবাহক মুহাম্মদ (সাঃ), তাঁর পরিবার-পরিজন ও সঙ্গী-সাথীদের প্রতি।

আল্লাহ্‌ বলেনঃ “প্রকৃতপক্ষে তারাই শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী এবং তারাই সঠিক পথে পরিচালিত, যারা নিজেদের ঈমানকে যুলমের সাথে (শিরক এর সাথে) মিশ্রিত করেনি।” (সূরা ৬: আল-আন’আম, আয়াত:৮২)

এই আয়াতটির পূর্বের আয়াতের সাথে সম্পৃক্ততা রেখে আমরা ঐ সম্প্রদায়ের মাঝে তুলনা করব যে কারা শান্তি অর্জন করবে।

আজ আমরা তাদের নিয়ে আলোচনা করব যারা জীবনে শান্তি অর্জন করবে, অভ্যন্তরীণ শান্তি, আত্মার শান্তি। আমাদেরকে জীবনে অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয় – আবেগ, ক্লান্তি, অবসাদ, হতাশা, দুঃখ কষ্ট রাগ দুশ্চিন্তা……

এতসবের মাঝে থেকে কীভাবে আমরা শান্তি অর্জন করব?

এই আয়াত থেকে তা শিখব।

বিশ্বাস এবং শান্তির মাঝে সম্পর্ক রয়েছে, মানসিক এবং শারীরিক শান্তি।

যারা সত্যিকার অর্থে ঈমান এনেছে, বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাদের সেই ঈমানের ছদ্মবেশে কোন খারাপ কাজ করেনি তাদের জন্যই আছে শান্তি। (ঈমান অর্থ বিশ্বাস স্থাপন, ছোটবেলা থেকে স্কুলের ধর্ম বইয়ে পড়ে আসছি ঈমান আনা মানে আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস স্থাপন এবং যেহেতু আমরা জন্মগত ভাবে মুসলিম এবং আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি তাই আমরা মনে করি আমরা ঈমান এনেছি। ঈমান আনা বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয় করে, আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ্‌ আমাদের যা বিধান দিয়েছেন তাই আমাদের জন্য সর্বোত্তম – এই কথাকে মনেপ্রাণে আঁকড়ে ধরে, এই কথার গভীরতা উপলব্ধি করে, আল্লাহ্‌র জন্য আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে শরীয়াতের পথে আসা, আল্লাহ্‌ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে সরে আসা।)

খারাপ কাজ শুধুমাত্র পৃথিবীর বুকে বিশৃংখলা অথবা যার সাথে অবিচার বা অত্যাচার করা হল শুধু তাঁর দুর্ভোগ ডেকে আনে না, যে অনাচার করে তাঁর মানসিক শান্তিও নষ্ট করে।

আল্লাহ্‌ চমৎকারভাবে এই আয়াতে আমাদের তা বলে দিলেন।

এবং সাথে আল্লাহ্‌ এটাও বলেছেন যে যারা নিজেদের অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারে, কারো প্রতি অবিচার-অত্যাচার করে না, শান্তি তাদেরই প্রাপ্য, তারাই শান্তি অর্জন করবে। সুবহানাল্লাহ!

যুদ্ধ থেকে আসা সৈনিক, যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছে, নিজেরা তাতে অংশ নিয়েছে, অথবা তারই কোনো আপনজন যুদ্ধের পাশবিকতায় অংশ নিয়েছে এবং সে তার নিরব সাক্ষী অধিকাংশ সময় তারা হয় আত্মহত্যা করে, অথবা দুঃস্বপ্ন দেখে। তারা ঘুমাতে পারে না, কারো সাথে সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না।

শুধুমাত্র শারীরিক দুর্ভোগ নয়, যুদ্ধের কারণে তাদের ভেতর যে মানসিক ঝড় বয়ে যায় যুদ্ধে তারা যে বর্বরতা, নৃশংসতা করেছে বা কর্তৃপক্ষের চাপে করতে বাধ্য হয়েছে তা তাদের মনকে ধ্বংস করে দেয়। তাদের আর কোন মানসিক শান্তি থাকে না, এই অবস্থায় তারা আর বেঁচে থাকতে পারে না।

অন্যায়-অপরাধ মানে যারা শুধু সন্ত্রাসী তারা নয়, বিনোদন জগৎ, সংগীতের জগৎ, সেলেব্রেটি, যেকোনো ব্যক্তি যার এসব ইন্ড্রাস্টির সাথে সম্পৃক্ততা আছে যা পাপাচার করে, তাদের সত্যিকার অর্থে মাদকের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতে হয় সুস্থিরতার জন্য। নতুবা তারা নিজের এবং অন্যদের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করে। মানিয়ে চলার জন্য তারা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে চলে যায়।

আল্লাহ্‌ বলেন, যারা আল্লাহ্‌র উপর সত্যিই বিশ্বাস স্থাপন করে, তারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় এমন শান্তি খুঁজে পায় যা তারা কোন ক্লাব, পার্টি, ড্রাগ, অ্যালকোহল কোন কিছুতে পায়না।

বিনোদনের জন্য আমরা মুভির পর মুভি, মুভির পর মুভি দেখে যাই, কিন্তু এটি আসলে আমাদের ভিতরকে তছনছ করে দেয়, এরপর আমরা যা করি তা হল ওই শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য অন্য কোন বিনোদনের আশ্রয় খুঁজি আর এভাবেই এ প্রক্রিয়া থেমে থাকে না ।

একসময় আমরা এসব বাদ দেবার সিধান্ত নেই এবং মসজিদে যাই এবং আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি খুঁজে পাই। অনেক দিন এই শান্তি থেকে দূরে থাকার কারণে আমরা টের পাই এতদিন আমাদের ভিতর কী বিষাক্ত ধারা বয়ে চলছিল আমাদের আত্মার মাঝ দিয়ে। এখন এই বিষ বের হয়ে যায় পবিত্র কুরআনের সুমধুর শব্দে, সবার সাথে একটুখানি মাটিতে হাত রেখে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যমে, একটু দেখি চিন্তা করে এই কয়েক মুহূর্ত আমাদের মাঝে কি আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেকদিন ধরে বাসি-পচা খাবার খেতে থাকলে হঠাৎ করে স্বাস্থ্যকর খাবার মুখে রুচিকর লাগে না। তেমনি অনেক দিন পর মসজিদে গেলে মন বসে না, মনে হয় কতক্ষণে বের হব। বিশেষ করে তরুণ সমাজ, এরা হয় মোবাইল অথবা অন্য কোন ডিভাইস নিয়ে আছে অথবা এট সেটা করছে, কারো মাঝে কোনো শান্তি নেই। ঈমান সেই শান্তিটাই আমাদের দেয়, শান্তি, সুস্থিরতা। আমরা আর কোন তাড়াহুড়া, বিরক্তির মাঝে থাকি না। আমরা এতটাই শান্তির মাঝে থাকি যে আমাদের আর কোন চোখের, কানের, ব্রেনের জন্য আলদা করে শান্তির পিছে ছোটা লাগে না। আমরা অনাবিল শান্তির মাঝে বিরাজ করি, মানসিক শান্তি। সুবহানাল্লাহ!

কিন্তু কোন ওয়াদা ছাড়া এই শান্তি চলে যেতে পারে। তাই আল্লাহ্‌ বলেন, আল্লাহ্‌র প্রতি ভালো কাজের ওয়াদা করতে, তাহলে এই শান্তি বিরাজমান থাকবে।

অন্যত্র আল্লাহ্‌ বলেন, আল্লাহ্‌র রাস্তায় থাকা মানুষের হৃদয় শান্তিতে ভরপুর থাকে।

জগতের প্রত্যেকটি মানুষ শান্তির পিছে ছোটে, মানসিক শান্তির সন্ধানে থাকে। ‘কিছু একটা’ তাঁকে সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা দেয়। সে ভাবে আমি যদি এটা পেতাম তাহলে আমি সুখি হতাম। যদি এই পরিমাণ টাকা থাকত, যদি ঐ মেয়ে আমার জীবনে থাকত, যদি আমি এই বাড়িটা থাকত, যদি আমার এই গাড়িটা থাকত, আমার ওই ডিভাইস থাকত ভিডিও গেমস্…… তাহলে আমি সুখি হতাম। কিন্তু কতক্ষণ সেই সুখ থাকে? একসময় আমাদের আর সেটা ভালো লাগে না এবং আমরা নতুন কিছুর পিছে পড়ি, আমরা সন্তুষ্ট হই না। সন্তুষ্টি আছে এই আয়াতে যা আল্লাহ্‌ আমাদের শিক্ষা দেন। এই আয়াত ইব্রাহীম (আঃ) এর বক্তব্য হলেও এই আয়াত কালজয়ী, এই সময়ের জন্যও প্রযোজ্য। সুবহানাল্লাহ।

“যারা সত্যিকার অর্থে ঈমান এনেছে, বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাদের সেই ঈমানের ছদ্মবেশে কোন খারাপ কাজ করেনি তাদের জন্যই আছে শান্তি।”

আমরা ঈমান এনে মুসলিম হলেই শান্তি খুঁজে পাব না। হয়ত আমরা আমাদের বিশ্বাসটাকে অন্যায় দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে দিয়েছি, আমাদের এই অপরাধ করা বন্ধ করতে হবে, জীবন থেকে এসব অনাচার বাদ দিতে হবে এবং আল্লাহ্‌ ইন-শা-আল্লাহ আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি প্রদান করবেন। আল্লাহ্‌ আমাদের আত্মাকে শান্তি প্রদান করুন এবং আমাদের প্রকৃত মুমিন বান্দায় পরিণত করুন। আমিন।

— :: — :: —