ব্যবসানীতি: মিথ্যার মাধ্যমে মানুষের টাকা গ্রাস করবেন না

পঞ্চম পারায় সূরাহ নিসা থেকে একটি আয়াত নিয়েছি, উনত্রিশ নম্বর আয়াত। খুবই শক্তিশালী শব্দচয়ন। ইসলামের অন্যতম বড় একটি মূলনীতি আনা হয়েছে আয়াতটিতে।

“তোমরা যারা ঈমানের দাবি করো…” 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ) 

“… পরস্পরের টাকা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে খেয়ে ফেলো না।”

কর্মক্ষেত্রে কর্মঘন্টার ব্যাপারে মিথ্যা বলবেন। যখন কার্ড পাঞ্চ করবেন, মিথ্যার আশ্রয় নিবেন না।

ধরুন আপনি একজন কনসালটেন্ট। নির্দিষ্ট কিছু ঘন্টার বিনিময়ে আপনাকে টাকা দেয়া হয়। হয়তো কোনো কাজ করে, বা কিছু ঘন্টা ব্যয় করে। তো আপনি বসে বসে কফি খেলেন, মজা করলেন, আয়েশ করলেন। সেসবের জন্যেও আপনাকে টাকা দেয়া হয়। এভাবে উপার্জন করবেন না, যদি না আপনার নিয়োগকর্তা বিষয়টি জেনে থাকেন। 

لَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ) 

“… তবে ব্যবসা হয়ে থাকলে ভিন্নকথা, যে ব্যবসা পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে।”

অন্যকথায়, কেউ সবসময় একশভাগ প্রোডাক্টিভ থাকতে পারে না। মানবিকভাবেই তা সম্ভব নয়। তাই, আপনার মনে হতে পারে, “আচ্ছা, ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করবো, তবে মাঝেমাঝে চল্লিশ মিনিটের ব্রেক নিবো। বসে থাকব, কথা বলব। করা যাবে?”

যদি আপনার নিয়োগকর্তা জানেন আপনি তা করছেন, আর এটা তিনি মেনে নেন, তাহলে ঠিক আছে, কারণ এটা পারস্পরিক সম্মতিতেই হচ্ছে। 

لَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ) 

যদি এটা ব্যবসা হয়, পরস্পরের সম্মতিক্রমে হয়, তবে ভিন্নকথা।

এ ছাড়া মানুষ থেকে জোচ্চুরি করে টাকা আদায় করবেন না। জিনিসের দাম মাত্রাতিরিক্ত ধরবেন না। আপনার কাজের জন্য মাত্রাতিরিক্ত মূল্য চাইবে না। যদি গাড়ির মেকানিক হয়ে থাকেন, আপনার দাম বাড়িয়ে দিবেন না। কারণ এই দশ মাইলের মধ্যে আপনি একাই মেকানিক। আপনি জানেন লোকটার গাড়ির ট্রান্সমিশনে সমস্যা, টাইমিং বেল্টে সমস্যা, ইঞ্জিন ফ্লুইড, আরো বিভিন্নরকম সমস্যা আছে। সে কি করবে? 

আপনি যদি ডাক্তার হন, মানুষের কাছে মাত্রাতিরিক্ত বিল চাইবেন না। একের পর এক, একের পর এক চার্জ চাইতে থাকবে না, যখন আপনি জানেন তারা দিশেহারা হয়ে আপনার কাছে এসেছে। মানুষকে এভাবে ধোঁকা দিবে না।

সুতরাং, মিথ্যার মাধ্যমে মানুষের টাকা খাবেন না। 

আবার, تَرَاضٍ মানে উভয়পক্ষই যে সার্ভিস বা প্রোডাক্ট বিনিময় হচ্ছে সে ব্যাপারে সম্মতি দিচ্ছে। সুতরাং আপনার বিক্রির প্রোডাক্টটার ব্যাপারে যদি কিছু জেনে থাকেন, বা আপনার সার্ভিসের বিষয়ে যদি কিছু জানা থাকে, যেমন ধরুন চুক্তির কাগজটা; যদি আপনি বুঝতে পারেন যে আপনার ক্রেতা বা নিয়োগকর্তা সে বিষয়ে জানেন না, তাদেরকে জানাতে হবে। তাদেরকে জানতে হবে। কারণ, যদি তারা না জানেন, আর আপনি এক রকম প্রতারণা করে তাদের টাকা বের করেন, সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। 

আমাদের সেলফোন চুক্তিগুলো যেরকম। চুক্তির কাগজটা থাকে। এটা হলো تِجَارَةً بِالْبَاطِلِ। কেননা আপনি এতসব ফি, এরপর ইনকনভিনিয়েন্স ফি, ইত্যাদি। আপনি জানেনও না এসব ফি কিসের জন্য। এসবের জন্য আপনি সম্মতিও দেননি। কিন্তু তবুও সেখানে জুড়ে দেয়া। চল্লিশ পৃষ্ঠা চুক্তির কাগজের একদম শেষে আপনাকে স্বাক্ষর দিতে হচ্ছে। তারাও জানে আপনি এগুলো পড়বেন না, যদি একজন স্বাভাবিক মানুষ হয়ে থাকেন। তো,  এটার সুযোগ নিয়ে তারা মিথ্যা চুক্তি তৈরি করে থাকে।

আমরা মুসলিমরা যখন ব্যবসা করব, বা পেশাদার কোনো চুক্তি বা চাকরির চুক্তিতে যাব, আমরা মিথ্যার মাধ্যমে টাকা খেতে পারি না। মানুষের টাকা খেতে পারি না। আর এটা কেবল চাকরিজীবীর ক্ষেত্রেই নয়, চাকরিদাতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এর মাধ্যমেই আলোচনা শেষ করব।

নিয়োগকর্তা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন দিবেন বলে ঠিক করেন। যদি তিনি জানেন যে অধীনস্ত চাকরীজীবীরা অধিক পরিশ্রম করছে, অধিক কাজ করছে, অথচ তিনি অধিক বেতন দিচ্ছেন না, অথবা একই কাজের জন্য কেউকে বেশি কেউকে কম দিচ্ছেন কিছুটা পক্ষপাতিত্বের কারণে, এটাও মিথ্যাচার। এটা ঠিক না। এটা আপনি করতে পারেন না।  একই পরিমাণ বেতন দিবেন, অথবা অন্য কেউকে বেশি দিবেন, যদিও তারা একই কাজ করছে, বিষয়টা অনৈতিক। আপনি তাদের টাকা আত্মসাৎ করছেন। কেননা এ টাকার মালিক আর আপনি নন। বেতন যাকে কম দিয়েছেন, আপনি তার টাকা লুট করেছেন। আর একমাত্র যে উপায়ে এ থেকে বাঁচতে পারেন তা হল عَنْ تَرَاضٍ, যদি শেষ পর্যন্ত তারা সম্মত হয়, সন্তুষ্ট থাকে এটা নিয়ে। আয়াতের একটা অসাধারণ বিষয় এটা। 

ক্রেতাকে কেবল রাজি করালেই হবে না। কেননা, তারা সম্মত না হয়েও রাজি হতে পারে। জানেন তো কিভাবে গাড়ি বিক্রেতারা ক্রেতাকে সম্মত না হলেও রাজি করায়, স্বাক্ষর নেয়, এরপর ক্রেতা আফসোস করে? 

ক্রেতাকে সম্মত হতে হবে। উভয়পক্ষকে সম্মত হতে হবে। চুক্তির ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে হবে। عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ । আয়াতটির সৌন্দর্য এখানেই। 

যদি উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট না হয়, তবে চুক্তিটা ন্যায়সঙ্গত হবে না। আর যখন চুক্তি হবে ন্যায়সঙ্গত, তখন অভিযোগ করার কোনো অধিকার নেই। কেননা, সকলেই সচেতন ও পরিষ্কারভাবে বিষয়গুলোতে রাজি হয়েছে। 

সুতরাং, এই নীতিতে যদি আমরা অটল থাকলে পারি, আল্লাহর কসম, আমাদের ব্যবসার কর্মকান্ড, প্রতিষ্ঠান, আমাদের চালানো কোম্পানি, এবং চাকরিজীবী হিসেবে আমরা আরো সুন্দর জীবনযাপন করতে পারব।

আল্লাহ (عَزَّ وَ جَلَّى আমাদের ব্যবসায়িক কাজে ন্যায়সঙ্গত হওয়ার তাওফিক দিন, সূরাহ নিসার এই আয়াতের সুন্দর নীতিটা বাস্তবায়ন করার তাওফিক দিন। 

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَ لَكُمْ وَ السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَ بَرَكَاتُهْ

— নোমান আলী খান