বন্ধুদের প্রতি দাওয়াহ

হরেক রকমের মানুষ আছে। আলহামদুলিল্লাহ। বিশেষ করে বর্তমানে মুসলিম সমাজে এমন মানুষ আছেন যারা ইসলাম মেনে চলার প্রতি অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছেন। তারা সত্যিই কিছু একটা করতে চান। আর তারা খুব হতাশ হয়ে পড়েন যখন দেখেন তার বন্ধুদের মাঝে সেই অনুপ্রেরণা নেই। তাই না?

প্রথমত আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে তাদের ব্যাপারে কারণ আপনি নিজেই আগে এতটা অনুপ্রাণিত ছিলেন না। এই অবস্থায় আসতে আপনার বেশ সময় লেগেছে। আবার আপনি হাল ছেড়েও দিতে পারেন না। আপনি বলতে পারেন না, ‘ওদের কথা ভুলে যাও, এরপরের বার আমি ওদের আর ডাকব না।’ না! আপনি তাদের সব সময় ডাকবেন, তাদের দাওয়াত দিবেন। আপনি তাদের বলতে থাকবেন, বলতে থাকবেন, বলতে থাকবেন এবং একদিন এমন একটা সময় আসবে যখন সে আপনার কথা শুনতে রাজি হবে। কারণ কেবল একটা কথাই যথেষ্ট যেটা কারও মুখ থেকে বেরিয়ে এসে আল্লাহর সাহায্যে ঠিক একটা বুলেটের মত হয়ে যায়। যেটা যেকোন বুলেটপ্রুফ খোলসের মধ্য দিয়ে গিয়ে একজন মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে। এটা তাদের এমনভাবে আঘাত করে যা তাদের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। আমার কথা কিংবা আপনার কথা কাউকে বদলে দিবে না। কিন্তু আল্লাহ যখন আমাদের কথায় শক্তি সঞ্চার করে দেন… তিনি যখন কোনো একবার শুধু একজন মানুষের জন্যে… হয়ত লাখো মানুষেরা এই ভিডিওটি দেখছে কিন্তু কেবল একজন মানুষ বসে দেখেছে যার কাছে এই কথাগুলো পৌঁছে গিয়েছে এমনভাবে যে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে তার জীবন কে বদলে ফেলবে, আর সে পারবে।

নুহ (আ) অবশ্যই একজন সুবক্তা, আমাদের কারও পক্ষেই তাঁর সমকক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। তিনি কত দিন যাবৎ একই শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন? ৯৫০ বছর! অথচ তেমন কোন পরিবর্তন দেখতে পাননি। তাই না? তার মানে আমরা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারি না। আর আমরা ভুলে যেতে পারিনা আল্লাহই মানুষকে পরিবর্তন করেন, আর অনুপ্রেরণা এমন অনুভূতি যা ধীরে ধীরে আসবে। যেমন, উমার। আমার সবচেয়ে প্রিয় উদাহরণ।

উমার (রা)। মহানবী (স) ইসলাম প্রচার করছিলেন পাঁচ বছর ধরে কিন্তু এই মানুষটা তখনও মুসলিম হয়নি। রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। প্রশ্ন হলো, এই পাঁচ বছর তাহলে তিনি কি করছিলেন? আমরা জানি তিনি কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। সেটা অন্য গল্প। কিন্তু আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন তিনি এই ৫ বছর ধরে কি করছিলেন তবে একটা শব্দে তার উত্তর দিতে পারবেন। আমোদ-ফূর্তি! মানুষটা শিকারে যাচ্ছিলো, ঘোড়ায় চড়ছিলো, মারামারি করছিলো। আপনি যদি তাঁকে ডেকে বলতেন, ‘চল, আমরা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলি কিংবা এরপরের জীবন নিয়ে কথা বলি।’

(তিনি বলতেন) ‘আমার তো একটু কাজ আছে। কিছু তীর-ধনুক ছুড়তে হবে!’
বুঝতে পারছেন আমি বলছি? তিনি সর্বক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন। এখনও আমাদের মাঝে এধরনের মানুষ আছে।
‘একটা লেকচার শুনতে যাবে?’
‘না ভাই, আমার একটা মুভি দেখতে হবে। আজকে তো আমার গেইম-টাইম, আজকে রবিবার বিকেল, ফুটবল খেলার সময়!’

যাই হোক। বুঝতে পারছেন? মানুষের অনেক কাজের প্ল্যান থাকে। কিন্তু আপনি তাদের ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিতে পারেন না। কারণ আল্লাহ তাদের হৃদয়কে এমন পাথরের সাথে তুলনা করেছেন যার ভিতরে পানি আছে। আপনি সেই হৃদয়ে টোকা দিতে থাকবেন, দিতে থাকবেন এবং একটা সময়ে তাতে ছোট্ট ফাটল ধরবে। আর যখন সেই ফাটল ধরবে পানি বেরিয়ে আসবে ঠিক যেভাবে ঈমান বেরিয়ে আসে। কিছু মানুষের জন্যে সহজেই এক রাতের মাঝেই সম্পূর্ণরূপে বদলে যাওয়া সম্ভব। আর কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অনেক সময় লেগে যায়। আর আপনার এধরনের মানুষের প্রতি সম্মান ধরে রাখা উচিত আর হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত না। আপনি তাদের ব্যাপারে হতাশ হবেন না। তাদের জন্যে দুআ করতে থাকুন। তাদের পিছে সংগ্রাম করতে থাকুন।

জানেন, আমরা যখন কাউকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেই আর তারা সাথে সাথে বদলে যায় না আমরা ভাবি, ‘এ তো কোনো কথাই শুনে না। কোনো পাত্তাই দেয় না।’ কিন্তু আপনি বুঝতে পারেন না আপনি যখন কাউকে কিছু বলেন এটা তাদের কানের ভিতর প্রবেশ করে, যেন এলার্জির মতন।কথাটা ভিতরে বসে থাকে হয়ত অনেক পরে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কথাটা তার ভিতরে টগবগ করতে থাকে এবং একটা সময়ে এসে সে্টা ইসলামে রূপ নেয়। উমার এর সাথে আসলে এটাই হয়েছিলো।

উমার এর গল্প এটাই। তিনি ইসলাম সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই শুনে আসছিলেন। তিনি স্বয়ং নবীর মুখ থেকে ইসলামের কথা শুনেছেন। তিনি একবার নবীকে মারতে চেয়েছিলেন, তিনি মুসলিম হওয়ার আগের কথা। তিনি কা’বার পর্দার পিছে লুকিয়ে ছিলেন। রাতের বেলায়। পর্দাও কালো। কা’বা অন্ধকার। তিনি সেখানে লুকিয়ে ছিলেন, একেবারেই দেখা যাচ্ছিলো না। সে সময় কোনো লাইটিং ছিলো না সেখানে। নবী প্রার্থনা করছিলেন, তিনি লুকিয়ে ছিলেন আর তিনি গোপনে নবীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। নবী প্রার্থনা করছিলেন, কুরআন পড়ছিলেন। নবী পড়ছেন আর উমার নিজে নিজেই ভাবছিলেন ,‘এটা অনেক সুন্দর। ওয়াও! সে নিশ্চয়ই একজন কবি।’ তিনি মুখে বলেননি কথাটা তবে ভাবছিলেন। কুরআনে তখন বলা হলো وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ ۚ قَلِيلًا مَا تُؤْمِنُونَ ‘এটা কোনো কবির রচনা নয়।’ নবী উমার এর কথা শুনতে পাননি তবে এটা ছিলো এর পরের আয়াত যা তিনি তিলাওয়াত করছিলেন। উমার ভাবছেন, ‘সে কিভাবে বুঝলো! সে নিশ্চয়ই একজন মর্মবিদ।’ এরপরের আয়াত ছিলো وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ ‘এটা কোনো মর্মবিদের রচনা নয়।’ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ ‘তোমরা কত সামান্য মনে রাখতে চাও। তোমরা কত সামান্য চেষ্টা কর মনে রাখার।’ تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘এটা হলো নাযিলকৃত বাণী সারা দুনিয়ার প্রভুর পক্ষ থেকে।’ তিনি শুনে এতটাই ভয় পেয়েছিলেন যে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। এটা সেই দিনের কথা না, যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এতটা আতঙ্কিত হয়েছিলেন এ আয়াত শুনে তিনি যদিও নবীকে আঘাত করতে এসেছিলেন তা না করেই পালিয়ে গেলেন। এই ঘটনারও অনেক পরে তিনি মুসলিম হয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘটনাতে প্রথম ফাটল ধরতে শুরু হয়ে গিয়েছিলো।

মতামত

comments