একটু কল্পনা করুন, আদম (আ) এর কেমন খারাপ লাগতো! যখন তিনি ভাবতেন যে, তিনি আল্লাহর কত নিকটে ছিলেন, আর এখন তিনি আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা থেকে কত দূরে!
তাকে এতো বেশি সম্মান এবং মর্যাদা দেয়া হয় যে ফেরেশতাদের পর্যন্ত নির্দেশ দেয়া হয় তাঁকে সেজদা করার জন্য। আর এখন তিনি এই পৃথিবীতে। প্রসঙ্গক্রমে, যে আয়াতে তাঁকে পৃথিবীতে নেমে যাওয়ার জন্য বলা হয় – اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ – ” তোমরা সবাই নীচে নেমে যাও।” এখানে আমাদের পিতা আদম (আ), আমাদের মা হাওয়া (আ) এবং ইবলিশ তিনজনকেই নীচে নেমে যাওয়ার জন্য বলা হয়। অর্থাৎ – এখন আমাকে এই জায়গা ইবলিশের সাথে শেয়ার করতে হবে! আমি ফেরেশতাদের সাথে থাকতাম আর এখন ইবলিশ এবং তার চেলা-চামুন্ডাদের সাথে থাকতে হবে?? আমার অবস্থাটা কেমন হয়ে গেল। এটা অপমানকর। তাঁর উপর তিনি আল্লাহ আজ্জা ওয়া জ্বাল থেকে দূরে থাকার বেদনা তো অনুভব করতেনই।
আল্লাহ তাকে এভাবে পাঠিয়ে দেয়ার সময় বললেন তোমার এবং তোমার সন্তানদের এখানে আবার উঠে আসার সুযোগ রয়েছে। তোমাদেরকে নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু আবার উঠে আসার সুযোগ রয়েছে। তাই আল্লাহ তাকে বলেছেন – فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ – “অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।”
জান্নাত থেকে নেমে যাও। কিন্তু যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো পথনির্দেশনা আসবে…এখানে বহুবচন ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ শধু আদম (আ) নয় বরং তার সন্তানদের প্রতিও যদি কোনো পথনির্দেশনা আসে, ইতিহাসের যে কোনো সময়…. যখন আমি হেদায়েত পাঠাবো তখন যে কেউ তা মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিবে তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না’।
তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না’। আর এটা শুধু এই জীবনের জন্য নয়; বরং فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ এই আয়াতের সত্যিকারের ইঙ্গিত হলো জান্নাতী জিন্দেগীর প্রতি। জান্নাতের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ উপহার হলো সেখানে কোনো ভয় এবং দুঃখ থাকবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে বলছেন – এই হেদায়েতের অনুসরণ করো তাহলে তুমি আবার জান্নাতে উঠে আসতে পারবে। তুমি আবার তোমার আদি গৃহ জান্নাতে ফিরে আসতে পারবে। আদম আলাইহিস সালামকে এই অঙ্গীকার দেয়া হয়েছিল। ঠিকাছে, ভালো কথা।
এভাবে ইতিহাসের পট পরিবর্তন হতে থাকে, শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হতে থাকে। একজন নবীর পর আরেকজন নবী এসে মানবজাতিকে আল্লাহর পথে ডাকতে থাকেন। আদম (আ) কে দেয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হিসেবে নবীরা এভাবে মানবজাতিকে আল্লাহর পথে ডাকতে থাকেন। যে, “হেদায়েত আসলে যে ব্যক্তি তা পালন করবে তার জন্য কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না।” সেই নবীদের খুবই ক্ষুদ্র একটা সংখ্যার কথা আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। وَمِنْهُم مَّن لَّمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ – “এবং কারও কারও ঘটনা আপনার কাছে বিবৃত করিনি।” এতো বেশি সংখ্যক নবী এবং রাসূল পাঠানো হয়েছে যে, অনেকের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
তো, আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হেদায়েত আসতে থাকে এবং অবশেষে তা চুড়ান্ত রূপ লাভ করে। আমাদের সবার জন্য সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মদ (স) এর নিকট পাঠানো হেদায়েতই হলো – সর্বশেষ হেদায়েত। আর সে হেদায়েত হলো – কুরআন। আল্লাহর রাসূল (স) কুরআনকে খুব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন – “কুরআন হলো আকাশ থেকে দুনিয়ায় আল্লাহর একটি সম্প্রসারিত রশি।” কুরআনেও এসেছে – وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا – “আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”
আর অনেক সাহাবীর মতে এখানে আল্লাহর রজ্জু হলো ‘আল-কুরআন।’ অর্থাৎ কুরআনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো। আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম, আমাদেরকে নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে আর তাই উপরে যেতে হলে নিশ্চয় কোন উপায় থাকতে হবে। এখন আমরা শিখছি যে, আমাদের জন্য দড়ি ফেলা হয়েছে। আর এটা এমন দড়ি لَا انفِصَامَ لَهَا – যা ভাংবার নয়। কোনো শিকলের সংযোগ ভাংবার মত নয় এটা। এটা সুদৃঢ়, ভঙ্গুর নয়। আর এটা এরকম সম্প্রসারিত অবস্থায় থাকবে, যতক্ষণ না মানব জাতির সমাপ্তি ঘটে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে যাবে, কিন্তু আল্লাহর এই সর্বশেষ রশি সবসময় থাকবে, এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে না।
আগেকার নবী যেমন মূসা আলাইহিস সালাম, সালেহ আলাইহিস সালাম, শোয়াইব আলাইহিস সালাম, নূহ আলাইহিস সালামের প্রতি যে হেদায়েতগুলো পাঠানো হয়েছিল একসময় মানুষ তা ভুলে যায়। সেগুলো হারিয়ে গেছে, অথবা মানুষ তা পরিবর্তন করে ফেলেছে। তাদের পক্ষে আর সেগুলো অনুসরণ করে সত্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু সর্বশেষ যে হেদায়েত পাঠানো হয়েছে তা চিরকাল থাকবে। আর এর অনুসরণের মাধ্যমে মানুষ আবার জান্নাতে আল্লাহর কাছে ফেরত যেতে পারবে। আর তা হলো – আল্লাহর বাণী আল কুরআন। আর সেই কুরআন…..অর্থাৎ আদম (আ) কে দেয়া প্রতিশ্রুতি যেটা সূরা বাকারার শুরুতে দেয়া হয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতি চুড়ান্ত রূপ লাভ করে যখন আল্লাহ ঘোষণা দেন – شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ – “রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন।”
এই কুরআন হলো আমাদের সবার জন্য, গোটা মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত উপহার, যা মেনে চলার মাধ্যমে মানুষ আবার তার আদি নিবাস জান্নাতে ফেরত যেতে পারবে। আর এই জান্নাতের আবাস্থল আমাদেরই জন্য তৈরী করা হয়েছিল, কারণ তা আমাদের পিতা আদম আলাইহিস সালামকে উপহার দেয়া হয়েছিল। যেন আমরা আবার আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারি।
এই আসন্ন রমজান মাসে আমরা আসলে কী উদযাপন করতে যাচ্ছি তার একটি ভূমিকা আপনাদের নিকট উপস্থাপন করলাম। আমরা আল্লাহর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন উদযাপন করতে যাচ্ছি। একটি প্রত্যাশার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন উদযাপন করতে যাচ্ছি।