প্রচেষ্টা বনাম ফলাফল

আজকের বক্তৃতার ওই অংশটা বিশেষভাবে বোনদের জন্য ছিল। কারণ তারা কঠোর পরিশ্রম করে এবং তাদের মনে হয় এই চেষ্টায় কোনভাবে কিছু হবার নয়। ছেলেরা এমন নয়। কারণ ছেলেরা কোন খাটুনি করে না এবং তারা মনে করে যে আমি তো অনেক করেছি। আমি কত কঠোর চেষ্টা করেছি। ছেলেরা, তোমাদের নিজের সাথে মিথ্যাচার বন্ধ করতে হবে। তোমাদের নিজেদের এটা বলা বন্ধ করতে হবে যে তুমি যথেষ্ট করছো। তোমাদের অলসতা দূর করতে হবে। ভাইয়েরা, শয়তান তোমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। সে তোমাদের ধ্বংস করছে। তোমরা এত অলস। তোমাদের এই অলসতা দূর করতে হবে। নিজেদের কাছে যুক্তি দেওয়া বন্ধ কর। অলসতা ঝেড়ে উঠ এবং কাজ কর। বেশি করে কাজ কর। যদি তুমি চাকুরী না পাও তবে চেষ্টা করতে থাক। আবেদন করতে থাক, করতেই থাক। অন্যদের সাথে এব্যাপারে কথা বলতে থাক, নেটওয়ার্কিং করতে থাক। থেমে যেয়ে বোল না যে আমি সবরকম চেষ্টা করেছি, তারপরেও ফল পায় নাই। না, তুমি সবরকম চেষ্টা কর নাই। উদ্যম হারিয়ো না। এটা করা তোমাদের শিখতে হবে। ছেলেরা তোমরা তোমাদের বোনদের কাছে থেকে শিখো। তারা হল…একটু অপেক্ষা কর…আমি তোমাদের ব্যাপারেও বলবো…একটু অপেক্ষা কর(মেয়েদের উদ্দেশ্যে)। কিছুক্ষণ পরেই তোমরা আর খুশী হবে না। তোমাদের সমস্যা কি জান? সুখের সন্ধানের কথা এখন ভুলে যাও। তোমাদের সমস্যা হল, তোমরা সর্বদা নিজেদের ব্যাপারে অনিশ্চিত। তোমরা সবসময় ভাবছো আমি যথেষ্ট নই বা আমি হিসেবের মধ্যেই নাই। (হাততালি)। হাততালি থামাও। তোমাদের ব্যাপারগুলো সহজভাবে নিতে হবে। তোমাদেরকে বলছি না(ছেলেদের উদ্দেশ্যে)। তোমাদের এমনিতেই সবকিছু যথেষ্ট হালকাভাবে নাও, মাশাআল্লাহ। অপরপক্ষে, তোমাদের শান্ত হওয়া দরকার।

আমার এমন বোনদের সাথে দেখা হয়েছে যারা ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করছে। তারা কুর’আন শিক্ষা করছে। “কিন্তু আমার এখনও সব শব্দ শেখা হয় নাই।” হ্যাঁ, ঠিক আছে! আন্টি শান্ত হন। আপনার সব শব্দ মুখস্ত হয় নাই। কিন্তু তাতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। আল্লাহ আপনাদের ফলাফলে আগ্রহী নয়। তিঁনি কিসের প্রতি আগ্রহী? তিঁনি আগ্রহী আপনার প্রচেষ্টায়। আপনার প্রচেষ্টায়। আপনার প্রচেষ্টায়। ফলাফল নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া বন্ধ করুন। আপনি আপনার ফল নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করেন। আপনি এখনও যা জানেন না, যেটা এখনও অর্জন করতে পারেন নাই সেটা নিয়ে আপনি বড্ড বেশি ভাবেন। অর্জন নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করুন এবং আন্তরিক, অকৃত্রিম, সর্বোচ্চ যতখানি সম্ভব চেষ্টা করা যায় তা করার ব্যাপারে চিন্তা করুন। আমি বলছি এমনটা করলে আল্লাহর কাছে থেকে ফলাফল আসবেই এবং সেটা যেন বৃষ্টির মত অবিরলভাবে আসবে। কিন্তু সেটা তাঁর সময়সূচী অনুযায়ী আসবে, আপনার নয়। দুইজন মানুষ একদম একই পরিমাণে চেষ্টা করবে। কোন একজন দেখা যাবে তার চেষ্টার ফলাফল নগদে পেয়ে যাবে এবং কাউকে বছর ভর অপেক্ষা করতে হবে সামান্যতম ফল পাওয়ার জন্যও। এটা আল্লাহর হাতে। এজন্য আপনি বলতে পারবেন না, “সে তো অনেক সুফল পেল আর আমি কিছুই পেলাম না। আমরা তো একই পরিমাণ চেষ্টা করলাম। এটা ঠিক হল না।” না, না, না। এটা পুরোপুরি ন্যায্য। কারণ সেই পঞ্জিকা আল্লাহর কাছে ন্যাস্ত এবং আল্লাহ শুধু এটাই দেখতে চেয়েছেন যে আপনি কতটা চেষ্টা করেন।

ধরুন দুইজন মানুষ একদম একই পরীক্ষা দিল। আমার ক্লাসে এমনটা ঘটেছিল। তারা একদম একই পরীক্ষা দেয়। একজন অনেক বেশি পরিশ্রম করে। সে দিন-রাত সারাক্ষণ পড়াশুনা করে। এই প্রোগ্রামে আসার আগে সে আমার বন্ধু ছিল। আমরা দু’জনে বন্ধু ছিলাম। আমি এখন তার শিক্ষক এবং আমি তাকে বলছি যে, ” চল, আমরা ঘুরতে যাই।” “না। আমাকে পড়তে হবে। পরীক্ষা আছে।” “আমি তোমার শিক্ষক।” “না। আমাকে পড়তে হবে। পরীক্ষা আছে।” “আমি তোমার সহজ পরীক্ষা নিব। তোমাকে অতিরিক্ত ক্রেডিট দেব। চল, আমরা খেলতে যাই। চল, চল।” “না। আমার পড়া আছে।” এই মানুষটা দিন-রাত, দিন-রাত, দিন-রাত পড়াশুনা করে। আমি জানি যে সে কি পরিমাণ চেষ্টা করলো। অন্য মানুষেরা জানে না। তার প্রচেষ্টার কথা আমি জানি। কিন্তু জানেন কি, সে তার ক্যারিয়ারে খুব উজ্জ্বল, ব্যবসায় এত দক্ষ, পেশাগতভাবে ভীষণ চটপটে ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যেন এমন ছিল যে আল্লাহ তাকে আরবী শেখার জন্য তৈরী করেন নাই। সে যত বেশিই শিখুক না কেন সে বেশি নম্বর তুলতে পারতো না। সে কোনমতে পাস করতো। কোন মতে পাস করত…প্রতিবারই। আর তার পাশের ছেলেটাই ছিল…অতিরিক্ত প্রতিভাবান, আমার দেখা সবচেয়ে অলস এক মানুষ। সে ক্লাসে সারাক্ষণ ঘুমাতো। সে প্রত্যেকবার নিরানব্বই বা একশ পেত। এতে আমার খুবই রাগ হত। আমি সেই ছেলেকে শূন্য পেতে দেখতে চাইতাম। আমি চাইতাম যে সে শূন্য পাক যেন আমি তার পরীক্ষার খাতা দিয়ে তাকে কঠিন এক চড় মারতে পাড়ি। আর যেই মানুষটা পড়তে পড়তে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে সে পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষক হিসেবে আমিই হতাশ হয়ে গেছিলাম। সেই ছাত্রের অবস্থা তাহলে চিন্তা করুন। শিক্ষক হিসেবে আমিই হতাশ। কিভাবে সম্ভব যে এই ছেলেটা কোন চেষ্টাই করে না আর সে ভাল ফল পাচ্ছে এবং এই মানুষটা যত ধরণের চেষ্টা সম্ভব সব করছে আর সে কোন ফলই পাচ্ছে না। মনে হয় যেন এটা অন্যায্য।

কিন্তু জানেন কি যখন এই দুই মানুষ আল্লাহর সামনে এসে দাঁড়াবে এবং দু’জনেই বলবে যে আমি আল্লাহর জন্য আরবী শিখছিলাম। হে প্রভু, আমি আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আরবী শিখছিলাম। আল্লাহ তখন বলবেন দেখি তোমরা কি করেছো। তাদের মধ্যে একজন দেখাবে নিরানব্বই এবং আরেকজন দেখাবে কুড়ি নম্বর। সেই দিন আল্লাহর কাছে কোনটা বেশি মূল্যবান হবে? ওহ! সেই কুড়ি নম্বর অমূল্য। সেদিন এটা মূল্যাতীত। কারণ আল্লাহ খাতার নম্বর দিয়ে মূল্যায়ন করছেন না। তিঁনি কি দিয়ে মূল্যায়ন করছেন? প্রচেষ্টা দিয়ে। সেই নিরানব্বই-এর মূল্য সেদিন হবে খুব খুব খুব কম। কারণ এটা পাওয়ার জন্য তাকে খুব বেশি চেষ্টা করতে হয় নাই। তাকে খুব বেশি চেষ্টা করতে হয় নাই। আল্লাহ এভাবেই বিচার করবেন। এটা পুরোটাই গুণগত মান সংক্রান্ত, পরিমাণ সংক্রান্ত নয়। মানুষ শুধু পরিমাণ বিচার করতে পারে। আল্লাহ গুণগত মান বিচার করবেন। আপনি এখন যা করছেন তার মান বিচার করুন, আপনার যাপিত জীবনের মান নির্ণয় করুন, আপনি যেই দিনটা পার করলেন তার মান, আজ সকালে আপনি কখন ঘুম থেকে উঠেছেন, সকালে কি ধরণের নাস্তা আপনি খেয়েছেন, আপনি কার সাথে কথা বলেছেন, আপনি কিভাবে সময় ব্যয় করেছেন, আপনি কি করেছেন, আপনার দিনের মান কেমন ছিল? সেটা আগে ঠিক করুন এবং ইনশাআল্লাহ ওয়াতাআলা তবে এই উম্মতের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।

কারণ আপনি একবার যদি পরম সত্যের ব্যাপারে চিন্তা করা শুরু করেন এবং আপনি প্রভাব নিয়ে চিন্তা করা শুরু করেন তবে এই ঘর থেকে নতুন চিন্তাভাবনা আসা শুরু করবে, সৃজনশীলতা আশা শুরু করবে, নিত্য নতুন প্রজেক্ট আসা শুরু করবে যেটা ক্রমান্বয়ে দুনিয়াকে বদলে দিতে পারে। সেটা দুনিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে যেমনটা আর কখনো করে নাই। মুসলিম তরুণ সম্প্রদায় এটা করতেই সক্ষম। তরুণ বিশ্বাসীরা এটা করার সামর্থ্য রাখে যখন তারা সঠিক সাধনার জিনিসটি খুঁজে পায়। আল্লাহ আজ্জা ওয়া যাল এই মানুষগুলোকে, এই তরুণ সম্প্রদায়কে এই উম্মতের বীরপুরুষ করুন, যারা সঠিক সাধনার সন্ধান করে। পরবর্তী প্রজন্ম এসে যেন বলে যে, “আমি তাদের হারাতে চাই। তারা ছিল যেন স্বর্ণতুল্য মানদণ্ড।” বারাকাল্লাহু লি ওয়ালাকুম। ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।