(পর্ব ৮)
নামাজের পূর্বেই নামাজের অবস্থায়:
যখন আমরা “সালাত”এর কথা বলে থাকি, আমরা সবাই মনে করি যে এটা আসলে শুরু হয় যখন আমরা দাঁড়িয়ে হাত তুলি এবং বলি “আল্লাহ আকবার”| কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়, এটা “আল্লাহ আকবার” বলারও আগে থেকে শুরু হয়| নবী(সা:) বলেন:
لا زال أحدكم في صلاة ما انتظر الصلاة
“একজন যতক্ষণ নামাজের জন্যে অপেক্ষায় থাকে, তার জন্যে ঐ সম্পূর্ণ সময় নামাজের মধ্যে ধরা হয়|”(বুখারী, মুসলিম)
পুরুষদের জন্যে, এটা সেই সময় থেকে শুরু হয় যখন সে নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে মসজিদে জামাতের সাথে নামাজের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে| যারা মসজিদে অবস্থান করছেন না এমন মহিলাদের জন্য এই নামাজের সময় শুরু হয় যখন তিনি অজু করে নামাজের জন্য সঠিক পোশাক(যদি তাঁর দরকার হয়) পরে নামাজের সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন তখন থেকে|
একটি গুপ্তধন:
শয়তান নামাজকে ঘৃনা করে| নবী(সা:) বলেন, “যখন আজানের শব্দ উচ্চারিত হয়, শয়তান তখন সশব্দে বায়ু ছাড়তে ছাড়তে দৌড়ে পালিয়ে যায় যাতে তার কানে আর আজানের শব্দ না আসে| আজান শেষ হলে আবার ফিরে আসে; ইকামাতের সময় আবার সে পালিয়ে যায় এবং শেষ হলে আবার ফিরে আসে, এবং মানুষের মনকে ফিসফিসিয়ে ধোঁকা দিতে থাকে(যাতে নামাজ থেকে মনোযোগ সরে যায়) এবং মানুষকে এমন সব জিনিস মনে করিয়ে দেয় যা নামাজের পূর্বে তার মাথায় ছিলনা এবং যার কারণে মানুষ ভুলে যায় যে সে কতো রাকাত নামাজ পরেছে|” [বুখারী] নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ন দিক যেটাকে আমরা আমলেই নেই না সেটা হল আজান| আমরা কি কখনো আজানের সুমধুর সুর-মূর্ছনা অনুভব করেছি? যে আজানের মাধুর্য আস্বাদন করে তার নামাজের খুশু বৃদ্ধি পায়| প্রশ্ন আসতে পারে যে খুশুর সাথে আজানের সম্পর্ক কি?
আজানের সময় হতেই শয়তান মানুষের মনকে অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতে থাকে, যাতে আজানের গুনাবলী থেকে সে কোন লাভ না পায়| তাহলে আজানের কি এমন বিশেষ গুন আছে?
আজান: একটি সুযোগ
নবী(সা:) বলেন:
المؤذن يغفر له بمد صوته ويصدقه من سمعه من رطب ويابس وله مثل أجر من صلى معه
“মুয়াজ্জিন(যিনি আজান দেন)কে তার আজান যতদুর পৌঁছে এবং যে তা শুনে আজানের শব্দ গুলোর সমর্থন দেয়(আজানের উত্তর) তার জন্য মাফ করে দেয়া হয়| যারা তার সাথে নামাজ পড়বে, তাকেও তাদের সমপরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে|”
তাহলে যদি ৫০ জন মানুষ নামাজ পড়ে, মুয়াজ্জিন ৫০ জনের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করে| যদি ১০০ জন নামাজ পড়ে তো ১০০ জনের সওয়াব পাবে| আমাদের প্রশ্ন হল: আমরা তো মুয়াজ্জিন না, আমাদের এতে কি লাভ আছে? হ্যাঁ, লাভ আছে, আমরাও মুয়াজ্জিনের সমপরিমাণ সওয়াব পেতে পারি| আবদুল্লাহ বিন আমর(রা:) বর্ণনা করেন যে এক ব্যক্তি নবী(সা:)কে জিগ্যেস করেন “মুয়াজ্জিন কি আমাদের চেয়ে বেশী সওয়াব পান?” এবং নবী(সা:) উত্তরে বলেন:
قل كما يقولون فإذا انتهيت فسل تعطه
“মুয়াজ্জিন যা বলে তা তুমিও বল আর যখন আজান শেষ হয়, তখন দোয়া করো, তাহলে তোমাকেও সে সওয়াব দেয়া হবে|”[আবু দাউদ]
যখন আজান “আল্লাহ আকবার” বলার মাধ্যমে শুরু হয় তখন, এটা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করে যে, আপনি যাই করছেন আল্লাহতায়ালা তার চেয়ে অনেক গুরত্বপুর্ন, তা সে টিভিতে কোন সিরিয়ালই হোক, অথবা নেটে বা পেপারে পড়া কোন লেখনী হোক আর কোন কথপোকথনই হোক| আর কেন আজান দেয়ার সাথে সাথে সবকিছু ছেড়ে নামাজের প্রস্তুতি নেবেন? কারণ-“লা-ইলাহা ইলা-আল্লাহ”-আপনি এক আল্লাহই বিশ্বাস করেন| যদি আজান আপনাকে আপনি যা করছেন তা থেকে সরিয়ে নামাজমুখী করতে না পারে তার মানে হল আপনি আল্লাহর চেয়ে এই কাজকে বেশী গুরুত্বপূর্ন মনে করছেন|
আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া কারও কোন ক্ষমতা নেই
আমরা জানি যখন আমরা আজান শুনি তখন আমাদের উচিত মুয়াজ্জিন যা বলে তা নিজে নিজে বলা| এটাই আজানের উত্তর| তবে “হায়া’আলা আস-সালাহ” (নামাজের জন্যে আসো) এবং “হায়া’আলা আল-ফালাহ” (সাফল্যের দিকে এসো) এই দুটোর উত্তরে বলতে হয় “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইলা বিল্লাহ” (আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া কারও কোনই ক্ষমতা নেই)|
এটা কেন বলি? আসলে এটা হল আল্লাহর কাছে আমাদের অসহায় আত্মসমর্পণ যে আল্লাহ তোমার সাহায্য ছাড়া নামাজে নিবিড় ভাবে মগ্ন থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব না, নামাজ সঠিকভাবে আদায় করাও সম্ভব না|
একটি আহ্ববান
মনে রাখা উচিত যে আজান হল আহ্ববান; এটা হল সবচেয়ে সুন্দর আহ্ববান যা আমাদেরকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র ইবাদাতের যোগ্য আল্লাহর দিকে ডাকে| যখন আমরা আমাদের অনেক ভালোবাসার কারও কাছে যাই আমাদের মাঝে আবেগ-উত্তেজনা কাজ করে, এক ধরনের আকাঙ্খা কাজ করে| আর এসবই শুরু হয় যখন অনেক ভালোবাসার সে বলে “দশ মিনিটের মাঝেই আমি তোমার সাথে দেখা করছি” বা “তুমি আসো এখনই দেখা করবো”| আমাদের মাঝে এক আজব সুখের অনুভূতি খেলা করে| আয়েশা(রা:) বর্ণনা করেন নবী(সা:) বলেছেন:
من أحب لقاء الله أحب الله لقاءه
“যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে পছন্দ করে, আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাত করতে পছন্দ করেন|” (বুখারী)
আজান আমাদের বলে যে এখন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময় হয়েছে| তাই যারা আল্লাহকে ভালোবাসে তারা তারাতারি করে প্রস্তুত হয়ে দেখা করতে মসজিদে বা জায়নামাজে দাড়িয়ে পড়ে, নামাজের শেষ সময়ের জন্য অপেক্ষা করে না| মুসা(আ:) কে দেখুন কি করেছিলেন:
وَمَا أَعْجَلَكَ عَن قَوْمِكَ يَا مُوسَى قَالَ هُمْ أُولَاءِ عَلَىٰ أَثَرِي وَعَجِلْتُ إِلَيْكَ رَبِّ لِتَرْضَىٰ ٰ
“(আল্লাহ বললেন)হে মূসা, তোমার সম্প্রদায়কে পেছনে ফেলে তুমি ত্বরা করলে কেন? তিনি(মুসা(আ:)) বললেনঃ এই তো তারা আমার পেছনে আসছে এবং হে আমার পালনকর্তা, আমি তাড়াতাড়ি তোমার কাছে এলাম, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও|” [সুরা তাহা ২০:৮৩-৮৪]
মুসা(আ:) আল্লাহকে প্রচন্ড ভালবাসতেন, এ কারণেই তারাতারি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশায় এত জোর কদমে এগিয়ে গিয়েছিলেন যে তার সম্প্রদায় তাল মেলাতে না পেরে পিছিয়ে পরেছিলো|
আজান কে উপভোগ এবং উপলব্ধি করতে থাকুন, ইনশা-আল্লাহ নামাজও উপভোগ্য হয়ে উঠবে| ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের নামাজ কে নিঁখুত ও সুন্দর করে তুলুন| আমীন|
(পর্ব ৯)
বিশ্বাসের মাধুর্যঃ
একটি প্রশ্ন: মনে করুন আপনি একজন অপরাধী, এবং আপনার অসংখ্য অপরাধের জন্য একজন বাদশাহ আপনাকে ৫০ বছরের কারাদন্ড দেবে। এবং আপনাকে বলা হল সেই ৫০ বছরের কারা ভোগের পর তিনি আপনাকে একটা প্রশ্ন করবেন। আপনি যদি সঠিক উত্তর দিতে পারেন, আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে। যদি সঠিক উত্তর দিতে না পারেন আপনাকে মৃত্যু দণ্ড দেওয়া হবে। আপনাকে যখন সেই কারাগারে নেওয়া হবে, ৫০ বছর আপনি কি নিয়ে চিন্তা করবেন? আপনি কি এটা ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবতে পারবেন যে – কি হতে পারে সেই প্রশ্ন?
এখন আরও একটু কল্পনা করুন যে, সেই কারাগারে আপনার সাথে আরও একজন বন্দি আছে যে বলল, আমি জানি বাদশাহ তোমাকে ঠিক কি প্রশ্নটি করবেন। আপনার তখন কেমন বোধ হবে? আপনি সেই প্রশ্নটি জানার জন্য আকুল হয়ে যাবেন। এবং জানার সাথে সাথে সঠিক উত্তরটি দেওয়ার জন্য যথা সাধ্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবেন।
বাস্তবে আমরা প্রত্যেকেই সেই কারাবন্দি মানুষ। কেয়ামত দিবসে সেই একটি বিশেষ প্রশ্ন আমাদের করা হবে, যার উত্তর আমরা যদি ঠিক মত দিতে পারি, তবে ইনশাল্লাহ আশা করা যায়, পরবর্তী সব কিছু সহজ হবে। আর যদি না দিতে পারি তবে তার পরিনতি ভয়াবহ। আজকে এখানে সেই প্রশ্নটি নিয়েই আলোচনা করা হবে যেটি জানার জন্য আমরা সবাই অধীর হয়ে আছি। এটি আমার কথা নয়, এটি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কথা –
أول ما يحاسب به العبد يوم القيامة هي الصلاة. فإن صلحت، صلح سائر عمله. وإن فسدت، فسد سائر عمله
আল্লাহর বান্দার কাছ থেকে কিয়ামাত দিবসে যে বিষয়টির হিসাব সবার প্রথমে নেওয়া হবে তা হল নামাজ। এই হিসাব যদি সন্তোষজনক হয় তাহলে তার পরবর্তী কাজ গুলো সহজ হবে। আর যদি তা অসন্তোষজনক হয় তাহলে তার পরবর্তী হিসাব হবে কঠিন।(তিরমিজী, বায়হাকি, নাসায়ী)
আমরা হব পরবর্তীতে উল্লেখিত পাঁচ ধরনের মধ্যে যে কোন এক ধরনের ব্যক্তি যে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হব। আমরা তাহলে কোন ধরনের হতে চাই?
মসজিদে খুশু নিয়ে নামাজ আদায়কারী
প্রথম ধরনের ব্যক্তি হবে সেই ব্যক্তি যে মযজিদে যায় এবং খুশু সহকারে জামাতে নামাজ আদায় করে অথবা সেই মহিলা যে আজান শেষ হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামায আদায়ের জন্য খুশু নিয়ে দাঁড়ায়। এটি হল সর্বোত্তম অবস্থা এবং আপনি যদি এই অবস্থায় ইতিমধ্যে থেকে থাকেন তাহলে তা দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে রাখুন। আল্লাহ বলেন –
الذين هم على صلاتهم يحافظون أُولائِكَ فِى جَنَّٰاتٍ مُّكْرَمُونَ
এবং সর্বোপরি যারা নিজেদের নামায হেফাজত করে, পরকালে এরাই আল্লাহর জান্নাতে মর্যাদা সহকারে প্রবেশ করবে। (সুরা আল মারিজ ৩৪-৩৫)
আল্লাহ এদের ব্যাপারে আরও বলেন-
أولائك هم الوارثون الذين يرثون الفردوس هم فيها خالدون
এ লোকগুলোই হচ্ছে মুলত জমিনে আমার যথার্থ উত্তরাধিকারী, জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারও এরা পাবে, এরা সেখানে চিরকাল থাকবে। (সুরা আল মুমিনুন ১০-১১)
ফিরদাউস হল জান্নাতের সর্বউচ্চ স্তর।
মসজিদে নামায আদায়কারী কিন্তু খুশুর অভাব
এই ধরনের ব্যক্তি মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করার জন্য পুরস্কৃত হবে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন-
صلاة الجماعة أفضل من صلاة الفرد بسبع وعشرين درجة
জামাতে নামায আদায়কারী একা নামায আদায়কারির চেয়ে ২৭ গুন বেশি সওয়াব পাবে।
তারপরও, খুশু না থাকা কোন হেলাফেলার বিষয় না। উমর (রাঃ) একদিন মসজিদের মিম্বরে দাড়িয়ে বলেন –
এমনও আছে কোন লোক ইসলামের পথে চলতে চলতে বৃদ্ধ হয়ে গেল অথচ সে একটি নামাজের জন্য ও পুরস্কৃত হলনা।
তখন তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করা হল।
তিনি উত্তরে বললেন – খুশুর অভাবে।
নামাজে পরিপূর্ণ খুশুর একটি উদাহরন দেখুন। একদিন সকালে আল কাসিম বিন মুহাম্মাদ (রাঃ) আয়েশা (রাঃ) এর কাছে গেলেন। তিনি তাকে নামাজে একটি আয়াত পরতে দেখেলন –
فمن الله علينا ووقانا عذاب السموم
‘আর এ কারনেই আজ আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর এ সব নেয়ামত দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন, সর্বোপরি তিনি আমাদের জাহান্নামের গরম আগুনের শাস্তি থেকেও রক্ষা করেছেন।’ (সুরা আত তূরঃ২৭)
উনি যখন এই আয়াতটি পড়ছিলেন, উনি কাঁদছিলেন এবং উনি আবার এই আয়াতটি পড়ছিলেন। এরকম তিনি এতবার করছিলেন যে আল কাসিম (রাঃ) বিরক্ত হয়ে বাজারে উনার দরকারি জিনিস কিনতে চলে গেলেন। সে যখন ফিরে আসলেন, দেখলেন আয়েশা (রাঃ) একই জায়গায় দাড়িয়ে তখনও সেই একই আয়াত পড়ছেন আর কাঁদছেন।
মুসলিম বিন ইয়াসার ও নামাজের নিষ্ঠার এমন আরেকটি উদাহরন। একদিন মসজিদের একটি অংশ ভেঙ্গে পড়ে গেল। লোকজন দৌড়ে সেখানে ছুটে আসলো কারন তারা জানত উনি এখানে নামায পড়ছিলেন। উনাকে সেখানে তখনও একভাবে নামাজে মগ্ন অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে পাওয়া গেল।
ঘরে নামায আদায়কারী
ঘরে নামায পড়া আর মসজিদে নামায পড়ার তফাত কি? প্রথমে আমাদের জানতে হবে মসজিদে নামায পড়ার বৈশিষ্ট কি। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন-
إذا أمن الإمام فأمنوا، فإنه من وافق تأمينه تأمين الملائكة غفر له ما تقدم من ذنبه
যখন ইমাম নামাজে আমীন বলেন, তোমরাও একই সাথে আমীন বলবে। যদি এটি ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যায় তবে তোমাদের পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে (বুখারি)।
সাইয়িদ আল মুসায়িব বলেন- ৪০ বছরে এমন কখনও হয়নি, মুয়াজ্জিন আজান দিয়েছে অথচ আমি মসজিদে উপস্থিত ছিলাম না।
আরেকটি চমৎকার ঘটনার উল্লেখ করছি। উবায়দাল্লাহ বিন উমার আল কাওারিরি বলেন-
আমি কখনও মসজিদের ঈশার জামাত ছাড়তাম না। একদিন, আমার কাছে এক মেহমান আসলে তার সাথে কথায় কথায় সময় কেটে যায়। হটাৎ খেয়াল হল ঈশার জামাতের সময় তো চলে গেল। আমি বসরার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে এমন মসজিদ খুজতে লাগলাম যেখানে তখনও জামাত শুরু হয়ে যায়নি। কিন্তু এমন একটি মসজিদ ও পেলাম না। রাসুল (সাঃ) এর সেই কথাটি ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরলাম যে উনি বলেছেন একাকি নামাজের চেয়ে জামাতে নামায ২৭ গুন উত্তম। তখন আমি ঘরে ২৭ বার নামায পরলাম। ওই রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি ঘোড়ার পিঠে একদল লোকের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করছি কিন্তু কিছুতেই তাদের ধরতে পারছিনা। তখন তাদের একজন বলল, তুমি কিছুতেই আমাদের ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। যখন আমি জিজ্ঞেশ করলাম -কেন, সে বলল কারন আমরা একত্রে নামজ পড়েছি, তুমি পড়নি। আমি অত্যন্ত কষ্ট নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম।
দেরীতে নামায আদায়কারী
আমরা যদি জানি যে আমাদের বিকাল ৪ টায় ফ্লাইট আছে, আমরা কি ৫ টায় পৌঁছব? না, কারন এখানে অনেক কিছু জড়িত, আমরা টাকা খরচ করে টিকেট কিনেছি, কেউ হয়ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, অথবা আমাদের ছুটি দরকার। এই সমস্ত কিছুর চেয়েও নামায অনেক বেশি জরুরি। তাহলে আমরা কিভাবে ফজরের নামায কাজা করতে পারি আর তা বেলা ১০ টায় আদায় করতে পারি? অথবা জোহর ও আসর একত্রে পড়তে পারি? অথবা মাগরিব নামায পড়তে ঈশার আজান পর্যন্ত দেরি করতে পারি?
আহমেদ বর্ণিত হাদিসে আছে,
من حافظ عليها كانت له نورًا وبرهانًا ونجاة يوم القيامة ومن لم يحافظ عليها لم تكن له نورًا ولا برهانًا ولا نجاة وكان يوم القيامة مع قارون وفرعون وهامان وأُبيَّ بن خلف
যে সবসময় সময় মত নামায আদায় করা চালিয়ে যায়, কিয়ামাতের দিন এই নামায তার জন্য হয়ে যাবে নুর, সাক্ষী এবং গুনাহ মাফের কারন। নতুবা তাকে দাড় করান হবে ফারাও, কারুন, হামান আর উবাই ইবনে খালাল এর সাথে।
যে নামায আদায় করে না
নামায পড়তে কতক্ষণ সময় প্রয়োজন? ৫ মিনিট? অথবা খুশু নিয়ে পড়লে ১০ মিনিট? তারপরও সারাদিনের আল্লার জন্য এই মাত্র ৫০ মিনিট আমাদের কাছে অনেক বেশী মনে হয়। এই হাদিসটি শুনুন-
بين الرجل وبين الكفر ترك الصلاة
একজন মানুষ ও একজন কাফিরের মধ্যে পার্থক্য কারী জিনিস হল নামায। (মুসলিম, বুই-১, হাদিস-১৪৭ )
নিজেকে জিজ্ঞেস করুন আপনি কোন প্রকারের মানুষের দলে পড়ছেন? আল্লাহ আমাদের সবাই কে যেন সেই প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত করেন। আমীন।
(পর্ব ১০)
ওযু
আমরা সবাই জানি, যথাযথ ভাবে ওযু করা নামাজের একটি পূর্বশর্ত। এ কারনে আমরা ওযুকে কেবল নামাজে দাঁড়ানোর আগের একটি প্রয়োজনীয় কাজ মনে করি। আমরা ভাবি, ঠিকভাবে ওযু না হলে নামাজে দাড়াতে পারব না, তাই আমরা এই নিয়তেই ওযু করি। কিন্তু ওযুর মহত্ত্ব এর চেয়ে অনেক বেশি। এটা দুঃখজনক যে আমরা ওযু থেকে কোনরকম উজ্জীবিত না হয়েই এতো বছর নামায পড়ে চলছি। ওযুর মধ্যেও কিছু গুপ্তধন আছে। কিন্তু এই গুপ্তধনের স্বাদ আস্বাদন করতে আগে আমাদের নিজেদেরকে একটু পরিবর্তন করতে হবে।
নিয়ত
আব্দুল্লাহ বিন মোবারক বলেছেন, “এমন কত কাজ আছে যা ছোট মনে করে করা হলেও তা হয় বেশি সম্মানিত; আবার এমন কত কাজ আছে যা অনেক বড় মনে করে করা হলেও তা হয়ে যায় সামান্য; নিয়তের কারনে।”
প্রথমে আমরা ওযুতে যে পরিবর্তন আনতে পারি তা হল এ থেকে প্রাপ্ত সওয়াবের পরিমান। কেউ কেউ বলতে পারে – ‘আমি তো ওযুর সমস্ত সুন্নাত পালন করি, পানির অপচয় করি না, শুরুতে শেষে দোয়া করি।’ তাহলে আর কিভাবে সওয়াব এর পরিমান বাড়ানো যাবে? লক্ষ্য করলে দেখবেন, ওযুতে আমরা যা যা করছি তা হল বাহ্যিক। যা বাকি রয়ে গেল তা হল – অন্তর। ইবনে আল কায়্যিম বলেছেন, যে বেক্তি অল্প আমল করল সে আল্লাহর নিকট বেশি আমলকারীর চেয়ে প্রিয় হতে পারে, যদি অল্প আমলকারীর অন্তর তার আমলে যুক্ত থাকে। এটা বোঝাতে তিনি একটি গল্প বর্ণনা করেন- এক লোক দেখল শয়তান মসজিদের দরজায় দাড়িয়ে আছে, ভেতরে ঢুকতে পারছে না। লোকটি ভেতরে তাকিয়ে দেখল, একজন লোক শুয়ে আছে আরেকজন দাড়িয়ে নামায পড়ছে। তখন সে শয়তান কে জিজ্ঞেস করল, যে লোকটি নামায পড়ছে তার কারনে কি তুমি মসজিদে ঢুকতে পারছনা? শয়তান উত্তর দিল- যে লোকটি শুয়ে আছে তার কারনে। কেন? তার মনের অবস্থার কারনে।
নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি যখন ওযু করছেন আপনার মনের উদ্দেশ্য বা নিয়ত টি কি? আমরা বেশির ভাগ বলব নিজেকে নামাজের জন্য প্রস্তুত করা। কিন্তু আমাদের অন্তর কে এখানে আরেকটু গভীরে প্রবেশ করাতে হবে এবং আরেকটি উদ্দেশ্য যোগ করতে হবে- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এটা অনেকটা কিছু দান করার মত। আপনি যখন বাড়ি ফেরার পথে ভিখারিকে কিছু টাকা দিলেন, আপনি হয়ত তা নিয়ে আর তেমন কোন চিন্তা ই করবেন না। কিন্তু যখন আপনি এই নিয়তে টাকাটা দিবেন, যে আপনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একজন অভাবীকে সাহায্য করছেন, তখন আপনার মনে অন্যরকম এক অনুভূতি আসবে, আপনি আরও অনুপ্রাণিত বোধ করবেন। আপনি নিজেকে সৃষ্টিকর্তার আরও নিকটে বোধ করবেন, তা ৫ টাকা দিয়েই হোক অথবা ৫০ টাকা।
আরেকটি উদ্দেশ্য যোগ করুন, সেটি হল আমাদের প্রিয় সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর সুন্নাহর অনুসরণ। আমাদের আরও নিখুঁতভাবে ওযু করার আগ্রহ জাগবে যখন আমরা চিন্তা করব আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কিভাবে ওযু করতেন। আমার মনে পড়ছে তখনকার কথা যখন আমি আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অনুসরণের উদ্দেশ্যে ছোট একটি পাত্রে ওযুর পানি নেই, এটি আসলেই আমাকে আরও উদ্দিপ্ত করে এবং আমি বুঝতে পারি ওযু করতে আমাদের কতই না অল্প পানির প্রয়োজন হয়।
পরিশেষে আমরা আরেকটি মাত্রা যুক্ত করতে পারি যাতে ওযুর ব্যাপারে আমরা আন্তরিক হতে পারি এবং একে আল্লাহর কাছে পছন্দনীও করতে পারি। তা হল- আমাদের কিছু গুনাহ মুছে ফেলার নিয়ত। ওযু হল পবিত্রতা আনয়নকারী কারন এটি আমাদের ছোট গুনাহ গুলকে ধুয়ে ফেলে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন – ‘যে বেক্তি উত্তমরূপে ওযু করবে তার শরীরের গুনাহগুলি ধুয়ে যাবে, এমনকি তার আঙ্গুলের নখের নীচ থেকেও।’ (মুসলিম)
ওয়াসওয়াসা
অনেকে নিখুঁতভাবে তাদের ওযু এবং নামায করার সময় এক কঠিন সমস্যার মুখমুখি হয়- ওয়াসওয়াসা; যা একধরনের মনের ফিসফিসানি, এখানে এটি একধরনের সন্দেহবাতিক বোঝায়। উদাহরনস্বরূপ, এমন বেক্তি যে নিখুঁত করার জন্য সন্দেহবশতঃ একাধিকবার ওযু করে এবং ঠিক হল কি হল না এই সন্দেহে একাধিক বার নামায ও পড়তে চায়।
আপনার যদি এই সমস্যা থেকে থাকে তাহলে তার সমাধান ও আছে ইনশাল্লাহ। অনেকে এটি প্রয়োগ করেছেন এবং বলেছেন তারা আল্লাহর রহমতে আরোগ্য লাভ করেছেন। আলেমরা বলেন, যারা এরকম তীব্র সন্দেহে ভগেন তারা যেন তাদের কাজগুলোর ব্যাপারে উত্তমটাই ধরে নেয়। যেমন কারো যদি সন্দেহ হয় আমার ওযু আছে কি নেই, তবে যেন তারা ধরে নেয় তাদের ওযু আছে। যদি কারো মনে হয় আমি কি তিন রাকাত পরলাম না চার রাকাত, সে যেন চার রাকাত ধরে নেয়। কেউ কেউ এতে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন। আসুন তাহলে এ ব্যাপারে মনে জাগা কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নেই। প্রথমত, আমরা কেন বারবার ওযু করব? আমাদের ভয় আমরা ঠিক মত ওযু করিনি বা আমাদের ওযু নেই এবং আল্লাহ হয়ত তা কবুল করবেন না। যেহেতু আপনি এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করছেন, জেনে রাখুন- আল্লাহ চান না আপনি বারংবার ওযু করবেন। কিভাবে বুঝবেন? মহানবী (সাঃ) বলেনঃ
“কেউ যদি পেটের অস্বস্তিতে ভোগে এবং নিশ্চিত হতে না পারে যে সে বায়ু ত্যাগ করেছে কিনা, সে যেন মসজিদ ত্যাগ না করে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে শব্দ বা গন্ধ পায়।” (মুসলিম)
এভাবে সে যেন ১০০% নিশ্চিত হয়।
ওযুর পরের কিছু দোয়া
কিছু দোয়া আছে যা ওযুর করে পড়া উচিত।
“আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুল্লাহি ওয়া রাসুলুহ”
(আমি সাক্ষ্য দিছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসুল।)
তাহলে তাঁর জন্য বেহেস্তের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হয়। সে ইচ্ছা করলে এর যে কোন দরজা দিয়ে (জান্নাতে) প্রবেশ করতে পারবে।(মুসলিম)
আবার,
“সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা আশহাদু আন লা লা ইলাহা ইল্লা আনতা আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইক”
এটি তাঁর জন্য শ্রেষ্ঠতম কাগজে লিপিবদ্ধ করে সীলমোহর দিয়ে বন্ধ করে রাখা হবে, যা কেয়ামত দিবসের আগে খোলা হবে না। (সহিহ আল জামিই)
আল্লাহ আমাদের হৃদয় দিয়ে ওযু করার তৌফিক দিন। আমীন।
(পর্ব ১১)
অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা
ওযু করে আমরা বাহ্যিক পবিত্রতা লাভ করি যাতে আমরা নামাজ পড়তে পারি। এখন বাহ্যিক পবিত্রতা লাভের পর আমাদের অভ্যন্তরীণ পবিত্রতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আর এই ওযুর মাধ্যমে সেটিও সম্ভব। ইবনে আল কাইয়িম বলেন-
اذا لقي العبد ربه يوم القيامة قبل الطهر التام فإنه لا يؤذن له بالدخول عليه كما أنه لا يؤذن له ان يدخل على ريه للصلاة الا بطهارة
‘কিয়ামাতের দিন বান্দা যদি সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র না হয়ে (গুনাহ থেকে) আল্লাহর সামনে হাজির হয়, তবে যেমন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে না, ঠিক তেমনি নামাজেও বান্দা পবিত্র না হয়ে তার রবের সামনে দাড়াতে পারবে না।‘
আমরা ওযুর পরে পড়ার একটি দোয়া বিবেচনা করে দেখি –
اللهم اجعلني من التوابين واجعلني من المتطهرين
“হে আল্লাহ, আমাকে সর্বদা তওবাকারীদের এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও”(তিরমিযি)
কাজেই, আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর জন্য নিজেকে সাজানোর আগে নিজেকে গুনাহ থেকে পবিত্র করতে হবে। এভাবে চিন্তা করে দেখুন, কোন জামা গায়ে দেওয়ার আগে সেটাকে কি ধুয়ে তারপর সুগন্ধি লাগাবেন, নাকি আগে সুগন্ধি লাগিয়ে পরে ধোবেন? নিশ্চয়ই আগে ধুয়ে পরে সুগন্ধি লাগাবেন।
উসমান (রাঃ) বর্ণনা করেন নবী করিম (সাঃ) বলেনঃ
من توضأ فأحسن الوضوء خرجت خطاياه من جسده حتى تخرج من تحت أظفاره
‘যে বেক্তি উত্তমরূপে ওযু করবে তার শরীরের গুনাহগুলি ধুয়ে যাবে, এমনকি তার আঙ্গুলের নখের নীচ থেকেও।’ (মুসলিম)
এবং আবু হুরায়রার বর্ণনায় বলা হয়, পানির শেষ ফোঁটার সাথে গুনাহ ধুয়ে যায়।
সুবহানআল্লাহ, ওযু কেমন ভাবে গুনাহ পরিষ্কার করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত করে দেয়। উসমান বিন আফফান (রাঃ) এর বর্ণনায়-
إن العبد إذا دعا بوضوء فغسل وجهه حط الله عنه كل خطيئة أصابها بوجهه فإذا غسل ذراعيه كان كذلك وإن مسح برأسه كان كذلك وإذا طهر قدميه كان كذلك
যখন কোন বান্দা ওযুর সময় তার মুখ ধোয়, সে মুখ দিয়ে যত গুনাহ করেছিল তা ধুয়ে যায়; যখন সে তার হাত ধোয়, একই জিনিস ঘটে; যখন সে তার মাথা ধোয়, একই জিনিস ঘটে এবং যখন সে তার পা ধোয়, তখনও একই জিনিস ঘটে। (আহমাদ)
কাজেই কল্পনা করুন, আমরা চোখ দিয়ে যে গুনাহ করি তা ধুয়ে যাবে, কান দিয়ে যে গুনাহ করি তা ধুয়ে যাবে এবং অন্যান্য অঙ্গের বেলায় ও তাই হতে থাকবে। অতএব, এখন থেকে আমরা যখন ওযু করব আমরা কল্পনা করব আমরা এই গুনাহ গুলি কে ঝরে যেতে দেখতে পাচ্ছি। এবং সবসময় বিশ্বাস রাখব আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।
আবু হুরায়রা আরও বর্ণনা করেন যে মহানবী (সাঃ) বলেন –
إسباغ الوضوء على المكاره وكثرة الخطا إلى المساجد وانتظار الصلاة بعد الصلاة فذلكم الرباط
فذلكم الرباط فذلكم الرباط
আমি কি তোমাদের ওই বিষয়ে বলবনা যা দিয়ে আল্লাহ বান্দার গুনাহ সমূহ মাফ করেন এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? সকলে বলল – নিশ্চয়ই হে আল্লাহর রাসুল। তিনি বললেন – কষ্টকর অবস্থায় থেকেও পুরনাঙ্গরুপে ওযু করা, নামাজের জন্য মসজিদে বার বার যাওয়া, এবং এক নামাজের পর আরেক নামজের প্রতীক্ষা করা; আর এ কাজ গুলই হল সীমান্ত প্রহরা। (মুসলিমঃ৪৯৪)
যা খুশি তাই করা?
এখন কেউ বলতে পারে, “বেশ, আমি তাহলে যা খুশি তাই করব, যত খুশি গুনাহ করব তারপর ওযু করে সব ধুয়ে ফেলব।” কিন্তু এরকম মোটেও নয়। আল্লাহর করুণা নিয়ে জাহেলিয়াতের যুগের অবাধ্যদের মত ব্যাঙ্গ তামাশা কোন ক্রমেই করা যাবে না। আল্লাহ বলেনঃ
وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
“এবং তারা (অবিশ্বাসীরা) শঠতা করল, তাই আল্লাহ ও কৌশল পন্থা গ্রহন করলেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন সর্বোত্তম কৌশলী।” (সূরা আল ইমরানঃ ৫৪)
আল্লাহ তাহলে কি করবেন? তিনি বিদ্রুপের জবাবে ওযুর ফযিলত দিতেই অস্বীকার করতে পারেন।
ওযুর চিহ্ন
আমরা অনেকেই হয়ত আবু হুরায়রা হতে বর্নিত এই হাদিসটি শুনেছি –
‘একদা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কবরস্থানে গিয়ে বললেনঃ “তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, এটা তো ঈমানদারদের কবরস্থান। ইনশাল্লাহ আমরাও অচিরেই তোমাদের সাথে মিলিত হব। আমার মনে আমার ভাইদের দেখার আকাঙ্খা জাগে। যদি আমরা তাদেরকে দেখতে পেতাম।” সাহাবাগন বললেনঃ হে আল্লাহ্র রাসুল, আমরা কি আপনার ভাই নই? জবাবে তিনি বললেনঃ তোমরা হচ্ছ আমার সঙ্গী সাথী। আর যেসব ঈমানদার এখনও (এ দুনিয়াতে) আগমন করেনি তারা হচ্ছে আমার ভাই। তারা বলল, হে আল্লাহ্র রাসুল! আপনার উম্মাতের যারা এখনও (দুনিয়াতে) আসেনি, আপনি তাদের কিভাবে ছিন্তে পারবেন? তিনি বললেনঃ অনেকগুলো কাল ঘোড়ার মধ্যে যদি কারো একটি কপাল চিত্রা ঘোড়া থাকে, তবে কি সে ঐ ঘোড়াটিকে চিনতে পারবেনা? তারা বললঃ হে আল্লাহ্র রাসুল! তা অবশ্যই পারবে। তখন তিনি বললেনঃ তারা (আমার উম্মতরা) ওযুর প্রভাবে জ্যোতির্ময় চেহারা ও হাত-পা নিয়ে উপস্থিত হবে। আর আমি আগেই হাওযে কাওসারের কিনারে উপস্থিত থাকব।…’(মুসলিমঃ ২/৪৯১)
কাজেই ওযু হল এমন একটি কাজ যার জন্য কিয়ামাতের দিন আমাদের মহানবী (সাঃ) আমাদেরকে আলাদা করে চিনতে পারবেন। আল্লাহু আকবর।
ওযু মর্যাদা বৃদ্ধি করে
একদিন সকালে মহানবী (সাঃ) ঘুম থেকে উঠলেন, এবং বিলাল (রাঃ) এর কাছে গিয়ে বললেন, “এটা কি রকম যে আমি জান্নাতে তোমার পদধ্বনি শুনতে পেলাম? উত্তরে বিলাল (রাঃ) বলল- হে আল্লাহর রাসুল, আমি এমন কোন গুনাহ করিনি যার জন্য আমি দুই রাকাত করে (তওবা জন্য) নামায পরিনি ; আর যতবার আমার ওযু ভেঙ্গেছে আমি আবার ওযু করে নিয়েছি। তখন মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন- “হ্যাঁ, এটাই ছিল তার কারন।” (ইবনে খুজাইমা)
মিসওয়াক
মহানবী (সাঃ) বলেছেনঃ
لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك مع كل وضوء
“যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টদায়ক না হতো, তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক নামাজের সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম” (মুসলিম ২/৪৯৬)
তিনি আরও বলেছেনঃ
السواك مطهرة للفم مرضاة للرب
“মিসওয়াক মুখ পরিষ্কার করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করায়”(আন নাসাঈ)
আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) কত বিচক্ষণ ও যত্নবান ছিলেন দেখুন- তিনি পরিষ্কার ও পবিত্র মুখ নিয়ে তবেই আল্লাহর সামনে দাঁড়াতেন। তিনি মিসওয়াক করা এতো পছন্দ করতেন যে, যখন তাঁর শেষদিন গুলোতে তিনি অসুস্থ ছিলেন, একদিন আয়েশা (রাঃ) এর ভাই আব্দুর রাহমান (রাঃ) তাঁর ঘরে ঢুকলেন, তাঁর হাতে একটি মিসওয়াক ছিল। আয়েশা (রাঃ) দেখলেন মুহাম্মাদ (সাঃ) মিসওয়াকটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তখন আয়েশা (রাঃ) তার ভাই এর কাছ থেকে সেটি চেয়ে নিলেন এবং চিবিয়ে নরম করে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে দিলেন।
(পর্ব ১২)
তাকবীর আল ইহরাম
তাকবীর আল ইহরাম হল নামাজের প্রথম এবং ফরজ একটি কাজ; এটি হল নামাজের শুরুতে আল্লাহু আকবার বলে আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করা।
আল্লাহু আকবার (আল্লাহ্ মহান) ই কেন? কেন আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর) বা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই)নয়? কারণ, আল্লহু আকবর এর অর্থ হল দুনিয়াবি যা কিছুই আছে আল্লাহ তার সমস্ত কিছুর চেয়ে বড়, মহান ও গুরুত্বপূর্ণ। সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণায় আল্লাহু আকবর বলা হয়; আমাদের নামাজে, আজানে, হজ্জে কঙ্কর নিক্ষেপের সময়, ঈদুল আযহায়, ঈদুল ফিতর এ। রমজান সম্পর্কে কুরআনের একটি আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেছেন –
“…আল্লাহ তায়ালা তোমাদের (কোরআনের মাধ্যমে জীবন যাপনের) যে পদ্ধতি শিখিয়েছেন তার জন্য তোমরা তার মহিমা বর্ণনা করতে এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা যেন আদায় করতে পার।“ (সুরা বাকারাঃ১৮৫)
যখন আমরা নামাযে বলি আল্লাহু আকবর, তখন আমরা আল্লাহর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ শুরু করি। ‘আল্লাহু আকবর’ অর্থাৎ আল্লাহ মহান – আমাদের কাজের চেয়ে, আমাদের দুশ্চিন্তার চেয়ে, অথবা যে খাবার রান্না করার চিন্তা করছি তার চেয়ে, বা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে। অর্থাৎ আমাদের মনের মধ্যে যা যা কিছু যত রকমই অন্য চিন্তা ভাবনা আছে তাদের সমস্ত কিছুর চেয়ে আল্লাহ মহান এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই কারনে, নামাজের প্রত্যেকটি ভঙ্গি পরিবর্তনের সময় আমরা বলি আল্লাহু আকবর- যাতে আমাদের মনে যদি নামাজের সময় অন্য চিন্তা ঢুকে পড়ে, এটি মনে করিয়ে দেয় যে এই চিন্তার বিষয়টির চেয়েও আল্লাহ বড়। কেবল মাত্র একটি জায়গায় আল্লাহু আকবর বলা হয়না, সেটি হল রুকু থেকে ওঠার সময়। এ বিষয়ে ইনশাল্লাহ পরে আলোচনা করা হবে।
হাত ওঠানো
আমরা যখন আল্লাহু আকবার বলি, আমরা হাত উঠাই। মহানবী (সাঃ) তিনভাবে এই কাজটি করতেন বলে হাদিসে উল্লেখ আছে।
১। আগে হাত তোলা। প্রথমে হাত উঠানো, হাত নামিয়ে বুকে বাঁধা এবং এরপর আল্লহু আকবার বলা
২। বলতে বলতে হাত উঠানো।
৩। পরে হাত উঠানো। আল্লাহু আকবার বলা, হাত উঠানো এবং এরপর হাত নামিয়ে বুকে বাঁধা।
এই তিনটি ই হাত তোলার বৈধ উপায়। এবং হাত কোন পর্যন্ত উঠাতে হবে? কান পর্যন্ত ও কাধ বরাবর- দুটিই সঠিক।
দা’ই মিশারি আল খারাজ পরামর্শ দেন এই তিনটি উপায়েই ঘুরিয়ে নামায পড়তে, যাতে আমাদের নামাজের কাজ গুলো অভ্যাসবশত যান্ত্রিক না হয়ে যায়, যাতে আমরা যা করি খেয়াল করে জেনে বুঝে মনোযোগ দিয়ে করতে পারি। এতে আরও একটা ব্যাপার নিশ্চিত হয় যে আমরা আমাদের নবীর (সাঃ) এর কোন সুন্নাত বাদ দিচ্ছি না। মহানবী (সাঃ) বলেন-
من أحيا سنة من سنتي فعمل بها الناس كان له مثل أجر من عمل بها لا ينقص من أجورهم شيئا
যে আমার রেখে যাওয়া সুন্নাহর কোন অংশ পুনঃপ্রচলন করবে যা হারিয়ে গিয়েছিল, তাকে তার অনুসারী সকলের সমান সওয়াব দেওয়া হবে, অথচ কারো অংশ থেকে কম হবে না। (ইবনে মাজাহ)
আল্লাহু আকবার বলতে আসলে কি বোঝায়?
কেউ কেউ আল্লাহু আকবার বলে, এবং মনে মনে এটাই বিশ্বাস করে। আর কেউ কেউ নামায শুরুই করে মিথ্যা দিয়ে। মিথ্যা বলে কারন তারা মুখে উচ্চারণ করে আল্লাহু আকবার কিন্তু হৃদয় মনে তার দুনিয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা এই উচ্চারণকৃত শব্দটির মর্মার্থ অনুভব করে না।
‘আল্লাহ’ হচ্ছে আমাদের রবের একটি অনন্য নাম, অন্য কাউকে এই নামে ডাকা হয় না, ডাকা যায় না; এবং এর দ্বারা তাকেই বুঝানো হয় যাকে ইবাদত করা হয় ও সিজদা করা হয়। তাঁর অন্যান্য রাজকীয় নাম দিয়ে কখনও কখনও মানুষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যেমন; সুরা হুদ এ মানুষ হযরত শুহাইব (আঃ) কে বলেছিল –
انَّكَ لَأَنتَ ٱلْحَلِيمُ ٱلرَّشِيدُ
নিশ্চয়ই তুমি ধৈর্যশীল (আল হালীম) ও নেককার (আল রাশীদ)। (সুরা হুদঃ ৮৭)
কিন্তু দুটি নাম কখনও মানুষের বেলায় ব্যাবহার করা যায় না, তা হল – ‘আল্লাহ’ ও ‘আর-রাহমান’। এ শুধু মাত্র তাঁর জন্যই।
“আকবার” কথাটি এসেছে তাকবীর থেকে; যার অর্থ মহিমান্বিত করা। আল্লাহ বলেন –
وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرً
তুমি (শুধু) তাঁর ই মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, পরমতম মাহাত্ম্য (সুরা বনি ইস্রাঈলঃ১১১)
আল্লাহর মহত্ত্ব এতই ব্যাপক ও বিশাল যে আমরা পরিপূর্ণ রূপে তাঁর বৈশিষ্ট্য ও মহত্ত্ব অনুধাবন করতে পারি না, তবে তাঁর সৃষ্টি সমূহ দেখে কিছুটা মাত্র আন্দাজ করতে পারি। পর্বতমালা, সমুদ্র, গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ এই সমস্ত কিছুর সৃষ্টি তো কেবল এটাই ঘোষণা করছে- আল্লাহু আকবার। তাহলে আমরা কিভাবে না করি?
হ্যাঁ, কিন্তু আমরা হাত উঠাই কেন?
আমরা হাত উঠাই আমাদের দুনিয়াকে পিছনে ফেলে আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণের জন্য। আপনি যদি কারো কাছে আত্মসমর্পণ করেন তাহলে দুই হাত তুলে বলেন- আমি সারেন্ডার করলাম। এখানে আমরা নামাজে দাড়িয়ে আত্মসমর্পণ করছি ভালোবাসা, আশা আর ভয় নিয়ে আমাদেরই সৃষ্টিকর্তার সামনে।
আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
আমরা যখন নামাজের শুরুতে আল্লাহু আকবার বলে হাত তুলি, আমাদের গুনাহ গুলি তখন ধীরে ধীরে আমাদের মাথা আর কাঁধে উঠে আসে। মহানবী (সাঃ) বলেন –
إن العبد إذا قام يصلي أُتي بذنوبه كلها فوضعت على رأسه وعاتقيه فكلما ركع أو سجد تساقطت عنه
যখন কোন বান্দা নামাজে দাঁড়ায়, তার সমস্ত গুনাহ তার মাথা এবং কাঁধে রাখা হয়; প্রতিবার যখন সে রুকু অথবা সিজদা করে, সেখান থেকে কিছু গুনাহ ঝরে পড়ে। (বায়হাকি, সহিহ আল জামিই)
আশ্চর্য ! আর কি হয় যখন আমরা নামায আরম্ভ করি? আল্লাহ আমাদের দিকে তাঁর দৃষ্টি ফেরান। নবী করিম (সাঃ) বলেন –
لا يَزَالُ اللَّهُ مُقْبِلا عَلَى الْعَبْدِ مَا لَمْ يَلْتَفِتْ
আল্লাহ তাঁর বান্দার দিকে ততক্ষন তাকিয়ে থাকেন জতক্ষন পর্যন্ত সে নামাজে সালাম না ফেরায় (আবু দাউদ)।
কতকিছু ঘটে যায় যখন তাকবীর দিয়ে আমরা শুধুমাত্র নামাজের প্রথম ধাপ শুরু করি। নির্দিষ্ট এক শয়তান তখন আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হয় যার একমাত্র কাজ হল আমাদেরকে নামাজের মধ্যে বিঘ্ন ঘটানো। নামাজে আপনি কথা বলা বন্ধ করে দেন, অকারণে নড়াচড়া বন্ধ করে দেন, এমনকি আপনার দৃষ্টিও এক জায়গায় নিবদ্ধ করে ফেলেন, আশেপাশে বা আকাশের দিকে তাকান না। আপনি তখন এক পবিত্র অবস্থানে থাকেন, আল্লাহর সাথে এক অন্তরঙ্গ আলাপে থাকেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন –
مفتاح الصلاة الطهور وتحريمها التكبير وتحليلها التسليم
পবিত্রতা হল নামাজের চাবি, এর শুরু হয় আল্লাহু আকবার বলে, শেষ হয় আসসালামু আলাইকুম বলে।(আবু দাউদ)
আপনি
আল্লাহু আকবার বলে আরেকটি জিনিস শুরু হয়। সেটি হল নিজেকে নিয়ে ভাবা। ভেবে দেখুন এই মহাবিশ্বে আপনার অবস্থান নিয়ে। ভেবে দেখুন তো এই বিশাল পৃথিবীর তুলনায় সূর্য কত বিশাল। আর এই সূর্যের তুলনায় অন্যান্য নক্ষত্র আরও বিশাল। সেই বিশালতায় আমরা কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য। আর এখন বলুন আল্লাহু আকবার…আল্লাহ এই সমস্ত কিছুর চেয়েও বড়, মহান।
(পর্ব ১৩)
মাথা নিচু করা
যেহেতু আমরা এখন নামায শুরু করেছি, আমরা আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভয়ের সাথে আমাদের মাথা নিচু রাখব। যখন মহানবী (সাঃ) নামাজে দাঁড়াতেন, আল্লাহ্র সামনে গভীর বিনয়ে মাথা নিচু রাখতেন আর দৃষ্টি সিজদার স্থানে রাখতেন। ইবনে আল কাইয়িম বলেন- যখন কেউ তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে দেখা করে তখন তার ভালোবাসার একটি বহিঃপ্রকাশ হল সে লজ্জা আর শ্রদ্ধায় মাথা নিচু রাখে, এবং আমাদেরও ঠিক এই রকম এ হতে হবে। মহানবী (সাঃ) বলেন-
فإذا صليتم فلا تلتفتوا فإن الله ينصب وجهه لوجه عبده في صلاته ما لم يلتفت
যখন কেউ নামাজে দাঁড়াবে, সে যেন এদিক সেদিক না তাকায়, কারন আল্লাহ তখন তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখেন যতক্ষণ না পর্যন্ত সে এদিক সেদিক তাকায় (তিরমিযি)।
মহানবী (সাঃ) আরও বলনে-
لا يزال الله مقبلا على عبده ما لم يلتفت
বান্দা নামাজের মধ্যে যতক্ষণ এদিক সেদিক দৃষ্টিপাত করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্র দৃষ্টি তার দিকে থাকবে (আবু দাউদ ২/৯০৯)।
আমরা অন্যদিকে ঘুরে গেলে কি হয়? নবী (সাঃ) বলেন –
فإذا صرف وجهه صرف عنه
অপরদিকে যখন সে এদিক ওদিক খেয়াল করবে, তখন আল্লাহ ও তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নিবেন। (আবু দাউদ ২/৯০৯)
এবং খেয়াল রাখবেন, ‘এদিক ওদিক খেয়াল’ করার দুটি অর্থ আছে – ১) অন্তরের এদিক সেদিক সরে যাওয়া, অন্যদিকে মনোযোগ চলে যাওয়া এবং অন্যান্য কথা চিন্তা করা, এবং ২) দৃষ্টি সরানো এবং ওপরে, ডানে-বামে তাকানো।
আপনি যদি কোন রাজা বাদশাহর সামনে যান, আপনি এদিক সেদিক ও তাকাবেন না, আবার সরাসরি তার চোখের দিকেও তাকাবেন না। যখন মহানবী (সাঃ)কে মিরাজে ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হয়, তাঁর বিনম্রতা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেন –
তাঁর কোন দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, এবং তাঁর দৃষ্টি কোন সীমা লঙ্ঘন ও করেনি (সুরা আন-নাজমঃ১৭)।
ইবন আল কাইয়িম বলেন – এটি হল আদব এর একটি উচ্চ পর্যায়। আমর বিন আল আস (রাঃ) বলেন, আমি ইসলাম কবুল করার আগে মহানবী (সাঃ) কে অত্যন্ত অপছন্দ করতাম। কিন্তু মুসলমান হওয়ার পর তাঁকে দেখে দেখে আমার চোখের সাধ কখন ও মিটত না। কিন্তু যখন তাকে নবীজির বর্ণনা করতে বলা হত তিনি তা করতে পারতেন না, কারন তিনি কখন ও সরাসরি উনার মুখের দিকে তাকাতেন না- এটি ছিল মহানবী (সাঃ) এর সামনে তার আদব।
বিনম্রতা
কখন ও ভাববেন না, আপনি যখন বিনীত হয়ে আল্লাহ্র সামনে দাঁড়ান, নিজেকে ছোট হতে হচ্ছে। মহানবী (সাঃ) বলেন-
من تواضع رفعه الله
আল্লাহ্র জন্য যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার সম্মান বৃদ্ধি করেন (মুসলিম ১৬/১৪১; আদ দারিমী ১/৩৯৬)।
নামাজে চোখ উঠানোকে নবীজি নিষেধ করেছেন। তাই অনেকে প্রশ্ন করে থাকে, তাহলে চোখ কি খোলা রাখতে হবে না বন্ধ করা যাবে? নামাজে চোখ বন্ধ করা নবীর সুন্নায় নেই, কিন্তু ইবনে আল কাইয়িম বলেন, যদি চোখ খোলা রেখে কিছুতেই খুশু না আসে তাহলে মাঝে মাঝে চোখ একটু বন্ধ করা যাবে।
হাতের অবস্থান
নামাজের তাকবীর দিয়ে নামায শুরু করলেন, আল্লাহ্র সামনে বিনয়ে দৃষ্টি অবনত করলেন, এবার বাম হাতের উপর ডান হাত অথবা বাম কব্জির উপর ডান হাত রাখবেন।(বুখারী ২/৭০৪ ইঃফাঃ)
এই ব্যাপারে কিছু রীতিগত মতভেদ আছে। যেমন হানাফি মাজহাবে নাভির নিচে, শাফি ই মাজহাবে নাভির কিছু উপরে। কেউ বুকে হাত বাঁধে, আবার মালিকি মাজহাবে দুই পাশে ঝুলিয়ে রাখে।
বাম হাতের উপর ডান হাত রাখার কারন কি? ইমাম আহমেদ কেও এক ই প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেন, আল্লাহ্র সম্মানে। আপনি যদি কোন প্রাসাদে ঢুকে দেখেন কিছু লোকের মাথা উঁচু এবং হাত কোমরে আর কিছু লোকের মাথা নিচু আর হাত বুকে জড়সড়; আপনি সহজেই বুঝে ফেলবেন কে রাজার লোক আর কে অধীনস্ত।
দুয়া আল ইস্তিফতাহ বা শুরুর দোয়া
আল্লাহকে সম্ভাষণ জানাতে আমরা নামাজের শুরুতে এই দোয়া পড়ি। আপনি যখন কারো সাথে দেখা করেন, বিশেষত এমন কেউ যাকে আপনি গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করেন, প্রথমেই তাকে আপনি আন্তরিক ভাবে সুন্দর করে সম্ভাষণ জানান। আরবিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষকে সম্ভাষণ জানানোর প্রচলিত রীতি আছে, যেমন; কাউকে শুভ সকাল জানাতে বলা হয় সাবা আল খায়ের অথবা সাবাহ আল ওয়ারদ বা সুবাসিত সকাল। নামাজের শুরুতে এই প্রারম্ভিক দোয়া টি সুন্নাত। যেহেতু আমাদের চেষ্টা নামাজকে সর্বাঙ্গীণ ভাবে সুন্দর করে আদায় করা, আমরা এর যতটা সম্ভব সমস্ত দিক আলোচনা করব এবং মহানবী (সাঃ) এর মত নামায পড়ার চেষ্টা করব।
ধরুন আপনার কোন প্রিয়জন আপানকে কোন একটা কাজ করতে অনুরোধ করল এবং আপনি তা করলেন না। তখন সে যদি আপনাকে ডেকে কাজটির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, আপনি তখন তার অনুরোধ না রাখার কথাটি হয়তো বলতে পারবেন না, বিব্রত বোধ করবেন। আল্লাহ্র সামনে আমাদের এই অবস্থা নিয়ে দাঁড়াতে হবে, কারন ভেবে দেখুন আমরা আল্লাহ্র কয়টি আদেশ পালন করেছি? কয়টি নিশেধাজ্ঞা মেনে চলেছি? একারণে আমরা কখনও কখনও নামাজে দাড়িয়ে অস্বস্তি বোধ করি। একারনেই আমাদের নবী (সাঃ) নামায শুরুর দোয়া হিসাবে আমাদের এই সুন্দর দোয়াটি শিখিয়েছেন –
للهم باعد بيني وبين خطاياي كما باعدت بين المشرق والمغرب اللهم نقني من خطاياي كما ينقى الثوب الأبيض من الدنس اللهم اغسلني من خطاياي بالثلج والماء والب
আল্লাহুম্মা বা-ঈদ বাইনি ওয়া বাইনা খতাইয়াইয়া কামা বা-আদতা বাইনাল মাশরিকি ওয়াল মাগরিব, আল্লাহুম্মা নাক্কিনী মিন খতাইয়াইয়া কামা ইউনাক্কাসাওবুল আবইয়াদু মিনাদ দানাস, আল্লাহুম্মা ইগসিলনী মিন খতাইয়াইয়া বিসসালজি ওয়াল মা ই ওয়াল বারাদ
“হে আল্লাহ, আমার এবং আমার গুনাহের মধ্যে এমন দূরত্ব তৈরি করে দিন যেমন দূরত্ব আছে পূর্ব ও পশ্চিম দিকের মধ্যে, হে আল্লাহ, আমার গুনাহকে আমার থেকে এমন পরিষ্কার করে দাও, যেমন শাদা কাপড় থেকে এর ময়লা দূর করা হয়। হে আল্লাহ, আমার গুনাহ গুলো ধুয়ে ফেল বরফ দিয়ে, পানি দিয়ে, শিলা দিয়ে” (বুখারি ২/৭০৮ ইঃফাঃ)
দোয়াটির প্রথম অংশে আমরা প্রার্থনা করছি যেন আমাদেরকে ওই পাপ থেকে দূরে রাখা হয় যেগুলো আমরা এখনও করিনি। দ্বিতীয় অংশে আমরা প্রার্থনা করছি যেন যে গুনাহ করে ফেলেছি তা পরিষ্কার করে ফেলা হয়। আর তৃতীয় অংশ আরও উর্দ্ধে, তা হল আমরা আল্লাহ্র কছে আমাদের পবিত্র করে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করছি।
আরেকটি ইস্তিফতাহ্ এর দোয়া নবীজি (সাঃ) করতেন তা হল-
سبحانك اللهم وبحمدك وتبارك اسمك وتعالى جدك ولا إله غيرك
সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়াবি হামদিক, ওয়াতা বারাক আসমুক, ওয়া তাআ’লা জাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গইরুকা
‘সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিক’ বলে আমরা ব্যক্ত করি যে আল্লাহ সমস্ত কিছুর উর্দ্ধে, এবং সমস্ত রকম ত্রুটিমুক্ত এবং সমস্ত প্রশংসা তারই জন্য। ‘তাবারাক ইসমুক’ বলতে বোঝায় যখন ই আল্লাহ্র নাম কোন কিছুর উপর নেওয়া হয় তা আল্লাহ্র অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয় এবং তাতে বরকত দেওয়া হয়। ‘ওয়া তা’আলা জাদ্দুক’ হল আল্লাহ্র সর্বময় ক্ষমতার উচ্চতম প্রশংসা। আর ‘লা ইলাহা গাইরুখ’ হল এতক্ষণ যা কিছু বলা হল তার স্বাভাবিক পরিনতি যে – তিনি ছাড়া আর কে আছে যে ইবাদতের যোগ্য।
এইসব চমৎকার দোয়া সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) বলেছেন এগুলো হল আল্লাহ্র পছন্দনীয় কথা। কিছু কিছু আলেম বলেন, প্রথম দোয়াটি পড়া হয় ফরজ নামাজে, আর দ্বিতীয় টি পড়া হয় নফল নামাজে।
এই দোয়া গুলো দিয়ে নামায শুরু করে আমরা আমাদের মনকে পরিষ্কার করতে পারি, নিজেদের বিনীত করতে পারি; এভাবে কুরান তিলাওাতের আগে আমাদের মনকে প্রস্তুত করতে পারব ইনশাল্লাহ।
(পর্ব ১৪)
আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া
আপনি কি জানেন, আপনি যখন নামাজে দাঁড়ান, শয়তান তখন প্রচণ্ড রকম হিংসা বোধ করতে থাকে। একারনেই সে নামাজে দাঁড়ানো ব্যক্তির মনকে ভিন্নমুখী করে তাকে নামাজের এই সুউচ্চ সম্মানিত অবস্থান থেকে সরিয়ে ফেলার সমস্ত রকম চেষ্টা চালায়। এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, বেশির ভাগ সময়ই আমরা শয়তানের এই প্ররোচনায় পড়ে যাই। শয়তানের সাদৃশ্য কিছুটা মাছির মত, যতবার দূরে তাড়ান, ঘুরে ফিরে আবার চলে আসে।
শয়তান
নামাজে কুরআন তেলাওাত করার আগে আমরা আল্লাহ্র কাছে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়া শিখেছি। এই শয়তানের প্রভাব বিপুল – আমরা যে জিনিস আগে ভুলেও গিয়েছিলাম নামাজে এসে সেই চিন্তা আমাদের মনে পড়ে যায়, আবার আমরা নানা রকম সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও চিন্তা করতে থাকি। যখন আমরা সবশেষে সালাম ফিরাই তখন আমাদের আর মনে থাকে না আমরা নামাজে কি কি পড়লাম বা কত রাকাত পড়লাম। আপনার অবস্থাও যদি এরকমই হয়, তাহলে ইবনে আল কাইয়িম এর মতে এই ব্যক্তির নামাজের শেষেও সেই অবস্থা থেকে যায় যেমনটি নামায শুরুর সময় ছিল; তার গুনাহের বোঝা যেমনটি ছিল তেমনই থেকে যায়। এই জীবনে যদি এমন অবস্থা চলতে থাকে, আমাদের পরকালে তাহলে কেমন অবস্থা হবে? কুরআন এ আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন সম্পর্কে বলেন –
وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدتُّكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ ۖ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُم مِّن سُلْطَانٍ إِلَّا أَن دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي ۖ فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنفُسَكُم ۖ مَّا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنتُم بِمُصْرِخِيَّ ۖ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِن قَبْلُ ۗ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
যখন বিচার ফয়সালা হয়ে যাবে তখন শয়তান জাহান্নামীদের বলবে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সাথে (যে) ওয়াদা করেছেন তা (ছিল) সত্য ওয়াদা, আমিও তোমাদের সাথে (একটি) ওয়াদা করেছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদের সাথে ওয়াদার বরখেলাপ করেছি; (আসলে) তোমাদের ওপর আমার তো কোন আধিপত্য ছিল না, আমি তো শুধু এটুকুই করেছি, তোমাদের (আমার দিকে) ডেকেছি, অতঃপর আমার ডাকে তোমরা সাড়া দিয়েছ, তাই (আজ) আমার প্রতি তোমরা (কোন রকম) দোষারোপ করোনা, বরং তোমরা তোমাদের নিজেদের ওপরই দোষারোপ করো; (আজ) আমি (যেমন) তোমাদের উদ্ধারে (কোনরকম) সাহায্য করতে পারব না, (তেমনি) তোমরাও আমার উদ্ধারে কোন সাহায্য করতে পারবে না; তোমরা যে (আগে) আমাকে আল্লাহ্র শরীক বানিয়েছ, আমি তাও আজ অস্বীকার করছি (এমন সময় আল্লাহ্র ঘোষণা আসবে); অবশ্যই জালিমদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব। (সুরা ইব্রাহীমঃ২২)
ভেবে দেখুন, কিয়ামতের দিন নিজের এরকম প্রতারিত ও পথভ্রষ্ট হওয়ার পর বিবেক যন্ত্রণায় বিদ্ধ অবস্থা। মহানবী (সাঃ) বলেছেন –
إن الرجل لينصرف وما كتب له إلا عشر صلاته ، تسعها ، ثمنها ، سبعها ، سدسها
خمسها ، ربعها ، ثلثها ، نصفها
‘এমন অনেক লোক আছে যারা নামাজ পড়ে কিন্তু তাদের নামাজ পুরপুরি কবুল না হওয়ায় পরিপূর্ণ সওয়াব প্রাপ্ত হয় না।বরং তাদের কেউ এক দশমাংশ, বা এক নবমাংশ, বা এক অষ্টাংশ, বা এক সপ্তাংশ, বা এক ষষ্ঠাংশ, বা এক পঞ্চমাংশ, বা এক চতুর্থাংশ, বা এক তৃতীয়াংশ, বা অর্ধেক সওয়াব পায়।’ (আবু দাউদ ১/৭৯০, ইঃফাঃ)
কাজেই শয়তান যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে আমাদের নামায থেকে চুরি করে সওয়াবের পরিমান কমিয়ে দিতে। আমাদের ভাবতে হবে যেন আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের পুরষ্কার পেয়ে গেছি কিন্তু আমাদের তা পাহাড়া দিতে হবে- কারন আমারা যখনই অমনোযোগী হই শয়তান আমাদের সওয়াবের কিছু অংশ চুরি করে নিয়ে যায়। এবং আমাদের কারো কারো ক্ষেত্রে শয়তান চুরি করতেই থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা খালি হয়ে যাই।
সমাধান
শেইখ আল-শিনকিতি বলেছেন, আল্লাহ আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে আমরা নিজেদেরকে মানুষ শয়তান এবং জীন শয়তান থেকে রক্ষা করব। আল্লাহ বলেন –
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ [٤١:٣٣
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ۚ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ [٤١:٣٤]
‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কোন ব্যক্তির হতে পারে যে মানুষদের আল্লাহ তায়ালার দিকে ডাকে এবং সে (নিজেও) নেক কাজ করে এবং বলে, আমি তো মুসলমানদেরই একজন।(হে নবী), ভাল আর মন্দ কখনই সমান হতে পারে না; তুমি ভাল (কাজ) দ্বারা মন্দ (কাজ) প্রতিহত করো, তাহলেই (তুমি দেখতে পাবে) তোমার এবং যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল, তার মাঝে এমন (অবস্থা সৃষ্টি) হয়ে যাবে, যেন সে (তোমার) অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হা-মীম-আস সাজদাঃ ৩৩, ৩৪)
এভাবে আমরা মানুষ শয়তান থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি, আমাদের খারাপ কে ভাল দিয়ে প্রতিহত করতে হবে। এটা আমাদের শুধু রক্ষাই না বরং হয়তো আমাদের শত্রুকে মিত্রতে পরিনত করতে পারে। কিন্তু এই কাজটিও সহজ নয়, আল্লাহ পরবর্তী আয়াতেই বলেছেন-
وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ
আর এ (বিষয়টি) শুধু তাদের (ভাগ্যেই লেখা) থাকে যারা ধৈর্য ধারন করে এবং এ (সকল) লোক শুধু তারাই হয় যারা সৌভাগ্যের অধিকারী (সুরা হা-মীম-আস সাজদাঃ৩৫)
কিন্তু জীন শয়তানের বেলায় কি করব? উপরের পদ্ধতিটি আমরা এক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবনা। তাহলে কি করব? আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে, কারন আল্লাহ্ উপরল্লখিত আয়াতের পরপরই বলেছেন –
وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“আর যদি কখনও শয়তানের কুমন্ত্রনা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে তুমি আল্লাহ্ তায়ালার কাছে আশ্রয় চাও; অবশ্যই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ” (সুরা হা-মীম-আস সাজদাঃ৩৬)
এটা একটা গল্পে সুন্দর করে বোঝান হয়েছে- এক বৃদ্ধ লোক এক যুবককে প্রশ্ন করল তুমি শয়তান কে দেখলে কি করবে? যুবকটি উত্তর দিল – মারব। বৃদ্ধের প্রশ্ন – আবার আসলে? আবার মারব। আবার একই প্রশ্নে যুবকটি একই উত্তর দিল। তখন বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বলল- রাস্তায় তোমার সামনে যদি একটি হিংস্র কুকুর আসে তুমি কতবার ওকে মেরে তাড়াবে? তারচেয়ে এটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ না যে তুমি এর মালিককে ডেকে কুকুরটাকে পথ থেকে সরাতে বল।
একারনেই আমরা নামাজের শুরুতে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় চাই। ইবনে আল কাইয়িম বলেছেন- আমরা যখন নামায পড়ি আল্লাহ্ তাঁর আর আমাদের মাঝের পর্দা উঠিয়ে দেওয়ার আদেশ করেন, আর আমরা সরাসরি আল্লাহ্র মুখমুখি হয়ে যাই, আবার যখন অন্যদিকে মন ঘুরিয়ে নেই, তখন আবার পর্দা নেমে আসে। শয়তান তখনই আমাদের মনে একটার পর একটা চিন্তা দিয়ে ব্যস্ত করে ফেলে, কিন্তু যখন পর্দা সরানো থাকে তখন সে এ কাজ করার সাহস পায় না।
কাজেই, আমরা আল্লাহ্র কাছে শয়তানের হাত থেকে আশ্রয় চাইব, অর্থ বুঝে নামায পড়ব এবং নিজেদেরকে নামাজের মাধ্যমে শয়তানের কাছ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করব।