বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমি সত্যিই সম্মানিত বোধ করছি এবং কিছুটা আশ্চর্যও হয়েছি আপনারা এতক্ষণ অপেক্ষা করেছেন দেখে আলহামদুলিল্লাহ্। আমার কণ্ঠস্বর কিছুটা ক্লান্ত মনে হতে পারে কারণ আমি আসলেই তাই … আট ঘন্টার টানা লেকচার ছিল কিন্তু আমি ইনশাল্লাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত কিছু কথা শেয়ার করব। এটা এমন একটা বিষয় যা এখন আর তেমন আলোচনায় আসে না কিন্তু এর প্রতি আমাদের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কোন সন্দেহ নেই যে এই বিষয়ের প্রতি আমাদের নজর দেয়া দরকার ইনশাল্লাহ।
আমি আপনাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি মুসলিম তরুণদের নিয়ে যারা কোন ধর্মীয় পথের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে পশ্চিমা সমাজে। তাদের মাঝে এক সংষ্কৃতি গড়ে উঠেছে। অনেক সময়ই মুসলিম তরুণরা যে জীবন যাপন করে তাকে বলা যেতে পারে … মনে করুন ‘পার্টিইং’ … ঠিক আছে … এবং তারপর জীবনের কোন এক সময় তারা কোন বিশেষ উপলব্ধির মুখোমুখি হয় এবং দ্বীনের পথে চলতে শুরু করে। এমন প্রচুর ভাই-বোন আছে যারা জীবনের কোন এক সময় পরিবর্তিত মানসিকতার ভেতর দিয়ে যায় এবং তারপর ধীরে ধীরে আরও ধার্মিক হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপর যা হয় তা হচ্ছে, যখন সময়ের সাথে সাথে তারা আরও ধার্মিক হয়ে ওঠে, তারা অনেক বেশি কড়া হয়ে যায় এবং নিজেদের জন্য নিজেরাই কোন শিক্ষক খুঁজে নেয়।
সেই শিক্ষক হচ্ছে কখনো কোন মানুষ, কখনো কোন লেকচার সিরিজ, কখনো কোন ওয়েবসাইট, কখনো ব্লগ, কখনো অপরিচিত কোন নাম কিন্তু সেটা যাই হোক না কেন, তারা নিজেদের জন্য একটা জ্ঞানের উৎস খুঁজে নেয় যেটাকে তারা “সঠিক” বলে মনে করে। এর প্রতি তারা খুবই অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং আস্তে আস্তে যা ঘটতে শুরু করে তা হচ্ছে তারা খুব কঠোর ও অনমনীয় হয়ে ওঠে। তারা লক্ষ্য করতে শুরু করে যে তাদের চারপাশের মানুষরা ঠিক তাদের মতো না। তারা যাকে শিক্ষক মানে তাদের চারপাশের মানুষরা তাকে শিক্ষক মানে না। তারা যেভাবে দ্বীনকে বোঝে অন্যরা সেভাবে বোঝে না। তাই প্রথমে যা হয় তা হচ্ছে তারা তাদের চারপাশের বিশেষ করে তাদের পরিবারের মানুষদের ব্যপারে হতাশ হতে শুরু করে। মুসলিম তরুণ বা তরুণীটি ভালোর দিকে পরিবর্তন হতে শুরু করে এবং সবার আগে তারা যাদের ওপর হতাশ হয়ে ওঠে তারা হচ্ছে তাদের নিজেদের পরিবার। “কেন তোমরা বোঝ না?” “এটাই দ্বীন পালনের সঠিক পথ!” এবং এমন আরও অনেক অনেক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
এমন ঘটনা ‘মুসলিম’ পরিবারের মাঝেই ঘটে। আপনি যদি মুসলিম হন এবং আপনার পরিবার যদি অমুসলিম হয় তাহলে এর মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু মুসলিম পরিবারের মাঝে থেকেও যদি আপনি দ্বীনকে নতুন করে আবিষ্কার করেন তাহলেও এমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই রকম সমস্যা শুধু পরিবারের মাঝেই যে সীমাবদ্ধ থাকে তা না বরং বন্ধুমহলেও এর বিস্তার ঘটে। অনেক সময় এমন হয় যে কেউ হয়ত আপনার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিল কিন্তু সে হয়ত কোন ধর্মীয় পথের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে না বা হয়ত সে যাচ্ছে কিন্তু সেই পথটা হয়ত আপনার মতো না। তাদের দ্বীনের বুঝ হয়ত কিছুটা অন্যরকম অথবা কিছু বিষয়ে হয়ত তারা আপনার মতো এতটা কড়া না। হয়ত কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে তারা আপনার মতো এতটা কঠোর না এবং এটা মেনে নেয়া আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আপনি তখন তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তোলেন। যখন আপনি এমন মানুষদের সংস্পর্শে আসেন যারা দ্বীনকে আপনার মতো করে দেখে না তখন এটাকে কেন্দ্র করে আপনি তাদের বুঝিয়ে দেন যে তারা ভুল আর আপনিই ঠিক; এভাবেই তাদের দ্বীন পালন করা উচিত এবং এছাড়া অন্য আর কোন পথ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন এক ধরণের আচরণ গড়ে ওঠে, বিশেষ করে তরুণদের মাঝে।
এমন আচরণের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তরুণ বা তরুণীটি নিজে মনে করে যে সে যা করছে তা হচ্ছে আমর বিন মা’রুফ ওয়া নাহিয়ান আল মুনকার। তারা মনে করে যে তারা ভালো কাজে আদেশ দিচ্ছে ও মন্দ কাজে নিষেধ করছে। তারা তো তাদের ভাই/বোনদের কোন হাদিস বা কোরআনের আয়াতই বলছে। ভালো কাজই তো করছে তারা! এটাই তো তাদের করা উচিত … এমন কথাই তাদের মাথায় থাকে। তারা যা বুঝতে পারে না তা হচ্ছে, এখানে আরও একটা ব্যপার ঘটছে। দ্বীনের পথে আসার আগে আপনি হয়ত বন্ধুমহলে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন, সকলের মধ্যমণি হয়ে থাকতেন। যখন আপনি ধর্মের পথে আসলেন তখন আপনাকে ঘিরে আর সেটা রইল না কিন্তু আপনার এখনো তেমন একটা কিছু চাই। অন্যদের ওপর নিজের আধিপত্য দেখানোর জন্য আপনার ভেতর এক ধরণের জিদ কাজ করে। আপনার মনে হয় যে, আমি মানুষকে দেখাতে চাই কোন না কোন ভাবে আমি তাদের চেয়ে সেরা এবং এই ঘুরপথে চলতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় নিজের অজান্তেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মাধ্যমে মানুষকে তারা নিজেদের ধর্মীয় মতামত জানাতে থাকে। তারা মানুষের কাছে প্রমাণ করে দিতে চায় যে অন্যরা আসলে ধর্মটা ঠিকমত জানে না।
“আমি ধর্ম সম্পর্কে ঠিকমত জানি, আসো তোমাকে বলি কোনটা সঠিক। আসো তোমাকে এই আয়াতটা শিখাই। এই হাদিসটা বলি। তুমি জান না যে এটা এভাবে না ওভাবে?”
মানে ধর্ম নিজেই আপনার #ইগো প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে।
এমন ঘটনা খুবই দুঃখজনক কারণ ধর্ম নাযিল হয়েছিল যেন আমরা নিজেদের বিনয়ী করে তুলি। কিন্তু এখন আমরা সেই একই ধর্ম ব্যবহার করছি নিজেদের অহংকার প্রকাশ করতে। তবে এমনটা যে শুধু আমাদের তরুণদের মাঝেই ঘটে তা কিন্তু না, বড়দের মাঝেও এমন হয়। আপনারা ইবলিসের কথা জানেন? সে কিসে আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল? সে সিজদাহ করতে রাজি হয়নি। আদম(আঃ)-কে আল্লাহ কী কাজ দিতে যাচ্ছিলেন? কেমন উচ্চ বেতন তিনি পেতে যাচ্ছিলেন? আদম(আঃ) কী পদোন্নতি পেতে যাচ্ছিলেন যেটা দেখে ইবলিস বলে উঠেছিল, না! না! না! আমি এই কাজের জন্য বেশি উপযুক্ত … কী ছিল সেই কাজ? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কী উদ্দেশ্যে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন? ইবাদতের উদ্দেশ্যে! ঠিক? এবং আদম(আঃ)-কে বলা হয়েছিলঃ ইন্নী জায়ীলুন ফিল আরদি খালীফাহ।
আল্লাহ উনাকে কোথায় ন্যস্ত করতে যাচ্ছিলেন? পৃথিবীতে। এবং কী ছিল উনার দায়িত্ব? আল্লাহর কাজ করা। এটা একটা ধর্মীয় উপাধি। আরও সহজভাবে যদি বলি, আদম(আঃ)-কে ধর্মীয় সম্মান দেয়া হয়েছিল, দুনিয়াবি সম্মান না। উনাকে কোন উচ্চ বেতন বা বিশাল বাড়ি দেয়া হয়নি। উনাকে ধর্মীয় মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। তাই আপনি যদি এই বিষয়টা নিয়ে ভাবেন তাহলে কিছুটা অবাক হবেন। ইবলিস এক ধর্মীয় মর্যাদার কারণে আদম(আঃ)-কে হিংসা করছিল। তার ইগো প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল কারণ সে মনে করছিল আল্লাহর দ্বীনের কাজ করার জন্য আদম(আঃ)-এর চেয়ে সে বেশি যোগ্য।
“দ্বীনের কাজ করার জন্য আমি বেশি যোগ্য।”
এই অহংকার প্রকাশ পেয়ে যায় যখন কেউ দাবী করে যে মসজিদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সে বেশি উপযুক্ত।
“প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আমিই বেশি উপযুক্ত, তাকে কেন বেছে নেয়া হলো?” “তাকে কেন এই কাজের দেয়া হলো?” “আমাকে কেন নেয়া হলো না?”
এটা একটা ধর্মীয় কাজ। প্রেসিডেন্ট হলে আপনাকে টাকা দেয়া হবে না। মসজিদ পরিচালনার জন্য আপনাকে নতুন গাড়ি দেয়া হবে না কিন্তু তারপরও আমেরিকাজুড়ে আমরা দেখতে পাই কিসের জন্য মানুষ জান দিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে? ধর্মীয় খেতাবের জন্য! মসজিদ পরিচালনায় কে থাকবে?? কার কথা শোনা হবে??
কিন্তু কেন??
এই রোগের সূচনা কোথায় হয়েছিল? সেই কাহিনী যথেষ্ট পুরান। এই রোগের ভাইরাস ইবলিসের থেকে শুরু হয়েছিল। সেও এই ধর্মীয় কর্তৃত্ব চেয়েছিল। মূল বিষয় হচ্ছে, এটা এক প্রকার অসুখ এবং এটা যদি কারও মাঝে থাকে তাহলে তার সেটা অতিসত্বর চিহ্নিত করা উচিত। যখন আপনার মনে হয়, “ভাগ্যিস আমি ছিলাম। আমি না থাকলে এই মানুষরা একদম বিপথে চলে যেত। এদেরকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য অন্তত আমি আছি!”, তখন আমি বুঝবেন যে এই মনোভাব আপনার ভেতরে প্রবেশ করেছে।
যদি এইরকম হয় আপনার মনোভাব তাহলে আপনি ভীষণ সমস্যার মাঝে আছেন। সত্যিই আপনি ভীষণ সমস্যার মধ্যে আছেন কারণ আপনি ভাবছেন এই দ্বীন কার ওপর নির্ভর করে? আপনার ওপর … দ্বীনের আমাদেরকে প্রয়োজন নেই; আল্লাহর দ্বীনকে আমাদের প্রয়োজন কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের আমাদেরকে প্রয়োজন নেই।
“ওয়াল্লাহু গানিয়ুন হামীদ”। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সমস্ত প্রয়োজন থেকে মুক্ত।
তাঁর আমাদেরকে প্রয়োজন নেই। আমাদের নিজেদেরকে আরও বিনয়ী করে তুলতে হবে। আমি এতক্ষণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইগোর কথা বললাম কিন্তু পরিবারের মাঝেও দেখা যায় যে আমরা বলছি, “আমি মারা গেলে কে এই পরিবারের দেখাশোনা করবে? কে বিল পরিশোধ করবে? আমি না করলে কে এইসব করবে?”
এমন ভাবনা আপনার মনে আসে, ঠিক? কিন্তু আপনি যতই ভাবুন না কেন যে আমার এত টাকা জমাতে হবে বা অত টাকা জমাতে, আমাকে প্রমোশন পেতে হবে বা ইত্যাদি, আমাদের মৃত্যু কবে হবে সেটা নির্ধারণ করা আছে। আপনি চিন্তা করেন আপনাকে কী কী করতে হবে কিন্তু যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ঠিক করেন যে আমি আজ রাতে মারা যাব তাহলে যা নির্ধারিত তা হবেই! এবং আমি চলে যাওয়ার পরে আমার সন্তান, আমার স্ত্রী, আমার স্বামী বা যেই হোক না কেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইতিমধ্যেই তাদের দেখাশোনা করছেন। আমি তাদের দেখাশোনা করছিলাম এটাই আমার কখনো ভাবা উচিত না। আমি তাদের দেখাশোনা করছিলাম না, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই সবসময় তাদের খেয়াল রাখছিলেন। আমিই নিজেকে ভোলাচ্ছিলাম এই ভেবে যে এসবকিছু আমার ওপর নির্ভর করে, কোন কিছু আমার ওপর নির্ভর করে না; কিছুই না! কারও ভালো করার ক্ষমতা আমার নেই। সকল ক্ষমতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার।