ইসলামের পথে হৃদয়কে অবিচল রাখা

ইসলামের পথে হৃদয়কে অবিচল রাখা

উস্তাদ নুমান আলী খানের কুরআন উইকলি তে দেয়া “Quranic Gems” সিরিজ থেকে নেয়া।
আজকে সুরা আল ইমরানের আট নম্বর আয়াত দিয়ে আমি আপনাদের সাথে একটি খুব শক্তিশালী এবং সুন্দর কুরআনের দুয়ার কিছু প্রতিফলন আলোচনা করতে চাই।

আমরা আল্লাহের কাছে প্রার্থনা করে বলে থাকি, রব্বানা লা তুজিগ কুলুবানা। আমি এই দুয়াটি সুরা আল ইমরান সকল আয়াত থেকে বিশেষ করে বেছে নিয়েছি, চিন্তা করে যে কোন আয়াত দিয়ে এই ভিডিও সিরিজ শুরু করা যায়, আমি এই আয়াতটি বেছে নিয়েছি কারন রমজান মাস বিশেষ করে এই দুয়া করার জন্য ভাল সময়। “মালিক আমাদের হৃদয়কে পথভ্রষ্ট হতে দিও না।” লা তুযিঘ কুলুবানা। যাঘা আরবি শব্দটির অর্থ হল যখন কোনকিছু হালকা বাঁকিয়ে যায় কিন্তু তা আমরা অনুধাবন করতে পারি না।

যেমন তারা এই শব্দটি ব্যবহার করতো কবর খননের সময়। যখন কবর খননের কথা থাকে আয়তক্ষেত্রের মত কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে কবর একাধারে খনন করার কারনে এর চারিদিক আর সরল রেখার মত থাকে না। যখন খনন শেষ হয় তখন দেখা যায় চারিদিকে একটু বাঁকা, মনেহয় প্রায় একটি ‘C’ (ইংরেজি শব্দ)। এই সমস্যার জন্য একে আরবিতে যাইঘ বলা হয়ে থাকে।

এখন যদি কোন মানুষ সোজা পথে যেতে থাকে আর সে না বুঝেই ভুল দিকে মোড় নেয় এবং পথভ্রষ্ট হয়ে যায় তখন তাকে বলা হয় যাইঘ।
সুতরাং দুয়াটি হল রব্বানা লা তুযিঘ কুলুবানা। আমাদের হৃদয়কে পথভ্রষ্ট হতে দিও না। পথভ্রষ্ট হওয়া মানে এই নয় যে আমরা একবারে ৯০ ডিগ্রি বেঁকে যাব, যে আমরা এইদিকে যাওয়ার কথা কিন্তু ঐ দিকে চলে গেলাম, আর পথ ভুলে গেলাম। তা নয়।

আমাদের হৃদয় যখন আল্লাহর সন্নিকটে যায় তখন তা আল্লাহ থেকে ক্ষণিকের মধ্যে দুরে সরে যায় না।তা আল্লাহ থেকে খুব অল্প অল্প করে দুরে সরে যায়।
এবং তাই আমরা আল্লাহের কাছে নিরাপত্তা চাই যাতে আমরা আস্তে আস্তে হলেও শেষ পর্যন্ত কোন উপলব্ধি ছাড়া যেন আল্লাহ থেকে দূরে সরে না যাই। অন্যথায় দেখা যাবে আমাদের উপলব্ধির আগেই আমাদের মধ্যে আর ঈমানের বোধ নেই।

এই মাসে আমাদের কেউ কেউ আল্লাহর নৈকট্য উপলব্ধি করছি যা আমারা অনেকদিন উপলব্ধি করতে পারিনি।

এবং আমরা নামাজ পড়ছি এবং মসজিদে থাকছি,সেখানে চারপাশে মানুষদের দেখছি, যাদের মধ্যে কেউ দুয়া করছে, কেউ কাঁদছে এবং আমরা ঐ পরিবেশে থেকে তাদের অনুভুতি বোধ করতে পারছি এবং আমরাও আল্লাহর দিকে ফিরে তাকাই এবং কাঁদা শুরু করি।
তখন আমরা ভাবি, “হায়, যদি আমার মনে সবসময় এরকম অনুভূতি থাকতো”। যখন নিজে নিজে ভাবি ,  “ হে আল্লাহ, যদি আমার মনে এই উপলব্ধি সবসময় থাকতো”,

ঐ সময় হচ্ছে এই দুয়া করার সময়। হে আল্লাহ আমাদের হৃদয়কে পথভ্রষ্ট হতে দিও না। বাএদা ইধ হাদাইতানা– “আমাদের পথ দেখানোর পর।”
এটি চমৎকার যে আল্লাহ বলেননি ‘তাকে পথ দেখানোর পর’, বাএদা ইধ হাদাইতাহা- হৃদয়কে পথ দেখানোর পর। তিনি বলেছেন আমাদের পথ দেখানোর পর, জানি আমরা পুরোটাই যেন শুধু হৃদয়।

তাই যদি আমাদের হৃদয় পথভ্রষ্ট না হয় তাহলে আমরা, আমাদের সম্পূর্ণ সত্ত্বাই যেন সঠিক পথে ধাবিত থাকবে। খুবই সুন্দর। তাই রাব্বানা লা তুযিঘ কুলুবানা বাএদা ইধ হাদাইতানা। এরপর উনি বলছেন, ওয়া হাব লানা মিন লাদুঙ্কা রাহমা। খুবি শক্তিশালী ভাষা। উনি বলছেন, “দান করুন আমাদের” হিবা এর আরবি মানে উপহার। ওয়াহাব- মানে হচ্ছে বড় উপহার দেয়া। অনেক বড় উপহার। হে আল্লাহ আমাদের এই মহান উপহার দান করুন, উদারতার উপহার, উপহার যা তোমার গোপন সংরক্ষিত জায়গা থেকে আসে।

এখানে আমি এই ভাষাটি সতর্কতার সাথে ব্যবহার করছি কারণ এই শব্দ ‘লাদুন’ এর মানে আরবিতে শুধু এই নয় যে তোমার কাছে থাকা কোন বস্তু, এর মানে হচ্ছে তোমার কাছে গোপনে থাকা কোন বস্তু । তোমার কাছে গোপনে থাকা কোন বস্তু যা অন্যকেউ কখনো দেখেনি। আর যখন সেখান থেকে বের করে কাউকে কিছু দেয়া হয়। এটা হল হাজা মিন লাদুন্নি- আর যদি আমার কাছে কিছু থাকে যেমন আমার পকেটে একটা কলম আছে এবং আমি তা তোমাকে দিলাম। হাজা মিন ইন্দি- এটা আমার পক্ষ থেকে। এবং ইন্দা শব্দটি কুরআনেও ব্যবহার করা হয়েছে।

তবে যখন তুমি লাদুন শব্দটি দেখ, তবে তা বিশেষ। এটি সাধারণ নয়, এটি আল্লাহর গোপন করুণা থেকে আসা। অন্যভাবে বললে,দয়া করে এটি মনোযোগ দিয়ে শুনুন, যেমন তুমি বলছ, “হে আল্লাহ…” 

“…আমি তোমার থেকে আগেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, অনেক বার।
আমি তোমার কাছে এসেছি এবং তারপর দূরে সরে গিয়েছি। এবং আবারো আমি তোমার কাছে এসেছি এবং তারপর দূরে সরে গিয়েছি। আমি এই অবস্থা আগেই পার করে এসেছি, এটি আমার জন্য একটি চক্র।”

এবং যখন তুমি কোন চক্রে পড়ে যাও তুমি চিন্তা করতে থাক, আমি নিজে নিজে চিন্তা করতে থাকি যে এটি আবার হবে। এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে নতুন কিছু নেই। এবং সেটাই হচ্ছে আল্লাহের কাছে চাওয়ার সময়, “ওয়া হাব লানা মিন লাদুঙ্কা রহমা”– হে আল্লাহ, তোমার ভাণ্ডারে নিশ্চই গোপন ক্ষমা আছে যা তুমি আমাকে দেবে এই চক্র থেকে বের হয়ে আসার জন্য।

এর তখনই আমি তোমার দিকে ধাবিত হতে পারবো এবং আমার হৃদয় আর পথভ্রষ্ট হবে না। তুমি জানো, এটি হচ্ছে আশার আয়াত। যেন আমরা আমাদের পূর্বের কৃতকর্মের দিকে তাকিয়ে না বলি যে, আমার কোন আশা নেই। আমি সবসময়ই এই চক্রে আবদ্ধ থাকি।
ওয়া হাব লানা মিন লাদুঙ্কা রহমাতান ইন্নাকা আন্তাল ওয়াহহাব। শুধু আল ওয়াহিব নয়- আপনি নিঃসন্দেহে উপহার দেয়ার মালিক যে অঢেল উপহার দেন এবং বার বার দেন।

হে আল্লাহ, আমি এই উপহার একবার চাই না। তোমার বিশেষ ভালোবাসা আর ক্ষমা এবং তোমার দেখানো পথ এবং আমার হৃদয়কে সরল পথে রাখা। এটি আমি একবার চাই না। আমি জানি আমার এটি আগামীকাল আবার দরকার হবে। তার পরের দিন আবার দরকার হবে এবং তারপরের দিনও দরকার হবে। তাই আমি তাকে ডাকি যে আমাকে একটানা, একটানা এবং বার বার এই উপহার দিবে। সুবহানাল্লাহ।

কী চমৎকার দুয়া আল্লাহকে বলার জন্য! আমরা বলে থাকি যে রমজানের জ্বর কমে যেতে থাকে এই মাসের পরে- এটি হচ্ছে এমন একটি দুয়া যা এই জ্বরকে কমতে দিবে না। আর আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে চাই এবং বলি, রব্বানা লা তুযিঘ কুলুবানা বা’দা ইধ হাদাইতানা ওয়া হাব লানা মিন লাদুঙ্কা রাহমাতান ইন্নাকা আন্তাল ওয়াহহাব– আশা করি আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার সুন্দর উপহার আর তার ভালোবাসার ক্ষমা দান করুন।

বারাকাল্লাহু লি ওয়ালাকুম, ওয়া-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
সবাইকে আসসালামু আলাইকুম।