“আল্লাহ” নামের পরিচিতি – ১ম পর্ব

আমরা আল্লাহর কয়েকটি নাম এবং গুণাবলী নিয়ে আমাদের আলোচনা আবার শুরু করছি। অবশ্যই আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রধান এবং সর্বাধিক পরিচিত নাম দিয়ে শুরু করবো আর সে নামটি হলো ‘আল্লাহ।’ আমাদের মালিক এবং সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে পরিচিত এবং কমন নাম হলো আল্লাহ। কুরআন মাজীদে এই নামটি অন্যান্য নামের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক বার ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন মাজীদে এই নামটি প্রায় ৩ হাজার পাঁচ শত বার উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআন শুরু করা হয়েছে এই নামটি দিয়ে। …. বিসমিল্লাহির রাহ মানির রাহিম। আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। কুরআনের সমাপ্তিও হয়েছে এই নামটি দিয়ে। … কুল আঊযু বিরাব্বিন নাসি মালিকিন নাসি ইলাহীন নাস।

এই নামটি পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোতেও পাওয়া যায়। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রাচীনতম যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় তাতে এমন এক ঈশ্বরের কথা উল্লেখ আছে যার উচ্চারণ “আল্লাহ” শব্দের উচ্চারণের কাছাকাছি। এই নামটি আমরা ওল্ড এবং নিউ টেষ্টামেন্টেও পাই ‘ইলো এবং ইলোহিম’ হিসেবে।

তাই এই নামটি প্রাচীন সভ্যতার মানুষদের কাছেও পরিচিত ছিল। কুরাইশদের নিকটও এই নামটি পরিচিত ছিল। বিস্ময়কর একটা ব্যাপার হলো, প্রাচীন ব্যাবিলন এবং কুরাইশদের নিকট “আল্লাহ” ছিলেন সকল ঈশ্বরের ঈশ্বর। তিনি ছিলেন প্রধান ঈশ্বর। তারা কখনো আল্লাহর জন্য কোনো মূর্তি তৈরী করেনি। কুরাইশরা আল্লাহকে চিনতো; তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ – (৪৩: ৮৭) আপনি যদি কুরাইশদের জিজ্ঞেস করেন কে তোমাদের সৃষ্টি করেছে, তারা বলবে আল্লাহ। সুতরাং তারা আল্লাহ নামটি সম্পর্কে জানতো। কখনো কখনো তারা আল্লাহর উপাসনাও করতো। কিন্তু তারা আল্লাহকে অনেক বেশি পবিত্র মনে করতো। মোটকথা আল্লাহ নামটি তাদের নিকট জানা ছিল।

এখন “আল্লাহ” শব্দটির অর্থ কী? এ সম্পর্কে অনেক অনেক মতামত রয়েছে, কিন্তু সময় স্বল্পতার দরুন সবগুলো মতামত আলোচনা করা সম্ভব নয়। একটি দলের মতে, আল্লাহ নামটি কোথাও থেকে উদ্গত (non-derived) হয়নি, এটি একটি প্রপার নাউন যার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু এই মতটি খুবই দুর্বল মত।

আরবি ভাষার অধিকাংশ ভাষাবিদ এবং তাফসীরকারকের মতে, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ শব্দের অর্থ আছে। এখন প্রশ্ন হলো এই নামটি কী অর্থ প্রকাশ করে? এই বিষয়ে ছয়টির অধিক মতামত পাওয়া যায়। আবারো আমাদের সংক্ষেপ করতে হচ্ছে। কিছু কিছু অভিমত হচ্ছে – “আল্লাহ” নামটি এসেছে ‘আলাহা’ ক্রিয়াবাচক শব্দ থেকে। আর ‘আলাহা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছুটে আসা, সাহায্য পাওয়ার জন্য আসা, কোথাও আশ্রয় পাওয়া, কোথাও অবলম্বন পাওয়া।

তাই এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট সবাই সাহায্যের জন্য ছুটে আসে। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট অন্তর প্রশান্তি পায়। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট সমস্ত সৃষ্টি জগৎকে অবশ্যই চাইতে হবে। আর এই অর্থটি সম্পূর্ণরূপে একটি বৈধ অর্থ। يَسْأَلُهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ – নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সবাই তাঁর কাছে প্রার্থী। তিনি সর্বদাই কোন না কোন কাজে রত আছেন। قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ – اللَّهُ الصَّمَدُ – এখানে “الصَّمَدُ” শব্দের অর্থ হলো – যার নিকট ফেরা হয় এবং কোনো কিছু চাওয়া হয়। সুতরাং “আল্লাহ” শব্দের অর্থ হলো – এমন সত্তা সবাই যার মুখাপেক্ষী। আল্লাহ নামের আরো অর্থ হলো….কিছু ওলামা বলেন, “আল্লাহ” শব্দটি এমন একটি ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে যার অর্থ হলো – উন্নত করা, ঊর্ধ্বে ওঠানো। আল্লাহ হলেন সর্বোচ্চ সত্তা। আর এটা সঠিক অভিমত। যেমন আমরা বলি, আল্লাহু আকবার। আল্লাহর আরেকটি নাম হলো, আল আ’লা। যেমন কুরআনে এসেছে – “সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা।” (আপনার সর্বোচ্চ প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা বর্ণনা করুন।)

আর তাই যারা আল্লাহর ইবাদাত করে তাদেরও মর্যাদা উন্নত করা হয়। يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ۚ – “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দিবেন।” আর তাই “আল্লাহ” শব্দের এই ব্যাখ্যা টিও একটি সঠিক ব্যাখ্যা।

“আল্লাহ” শব্দের তৃতীয় যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা হলো – আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যিনি আমাদের মনকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলেন, এমন সত্তা যাঁকে আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধির পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। অন্য কথায়, আপনি আল্লাহ সম্পর্কে যত জানবেন তত বেশি অবাক হবেন। তো, এটা হল আরেকটি ব্যাখ্যা। এই সবগুলো ব্যাখ্যাই যুক্তিসিদ্ধ।

যাইহোক, তবে সবচেয়ে শক্তিশালী মতামত হলো – “আল্লাহ” শব্দটি “আলিহা – ইয়া’লাহু” থেকে এসেছে। আর ‘আলিহা’ শব্দের অর্থ হলো – ইবাদাত করা। সুতরাং আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যাঁর উপাসনা করা হয়। এটাই সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার উপাসনা করা হয় এবং যিনি উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। কেউই আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালার মত উপাসনা পাওয়ার যোগ্য নয়। এটাই অধিকাংশ আলেমের মত।

যদিও পূর্বে উল্লেখিত মতামতগুলোও সঠিক। সেখানে ভুল কোনো মতামত ব্যক্ত করা হয়নি। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার নিকট আপনি সাহায্যের জন্য ছুটে আসেন। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার জ্ঞান মানুষের মন মানসকে বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে ফেলে। আল্লাহ হলেন এমন সত্তা যার স্মরণে আপনার মন প্রশান্তি লাভ করে। أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ – “আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।” এই সবগুলো মতই যুক্তিসিদ্ধ।

ইনশাআল্লাহ চলবে…