এখানে আমি প্রফেসর জেফ্রি লেংস এর ঘটনা শেয়ার করতে চাই। অসাধারণ এক লেকচার! তার ঘটনা শুনে আমি হতভম্ব। তাঁর কথা শুনে সম্পূর্ণরূপে অভিভূত। তিনি একটি কঠোর পরিবেশে বড় হন। তাঁর মা একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন। তিনি একজন নার্স ছিলেন, একটি হাসপাতালে নিয়মিত কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত কাজও করতেন। সবাই তাকে ভালোবাসতো। যখনই তিনি হাসপাতালে তার মাকে আনতে যেতেন, সেখানকার রোগীরা বলতো- তোমার মা তো একজন সাধু মহিলা। তার মায়ের মৃত্যুর পর লোকজন এসে বলতে লাগলেন তার মা কেমন ভাল মহিলা ছিলেন। মোটকথা চমৎকার এক মহিলা ছিলেন; জেফ্রি ও তার ভাইয়ের জীবনে তিনি গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেন।
অপরদিকে, তার বাবা ছিলেন একজন মদ্যপায়ী, খারাপ মানুষ; যিনি তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়মিত মারধোর করতেন, গালিগালাজ করতেন। জেফ্রি তার মাকে জীবনে একটি বারের জন্যও গালি দিতে শুনেন নি। তার বাবা তাকে এবং তার মাকে নিয়মিত প্রহার করতেন। মোটকথা তার বাবা খুবই জঘন্য চরিত্রের এক মানুষ ছিলেন।
দেখতে দেখতে জেফ্রি ষোল বছর বয়সে পৌঁছে গেলেন, কিন্তু তিনি এর কোন কারণ খুঁজে পেলেন না। তিনি একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান হিসেবে বেড়ে উঠেন। তার মা খুবই ধার্মিক একজন মহিলা ছিলেন। তিনি ভাবতেন- “কোন ধরনের প্রভু এটা ঘটতে দিতে পারেন? কোন কারণে তার মা এর যোগ্য হল? কী দোষ ছিল আমার, কেন আমি সবসময় এরকম মার খেতাম?” তিনি সবসময় গডের কাছে প্রার্থনা করতেন যেন পরিস্থিতি ভাল হয়ে উঠে। পরিস্থিতি কি ভাল হয়েছিল? না, হয়নি। বাচ্চা বয়সে তিনি এভাবে প্রার্থনা করতেন, কিন্তু কোন জবাব পেলেন না। তারপর কী ঘটলো? তিনি ভাবতে লাগলেন- “কেউ কি আসলে আমার প্রার্থনা শুনছে? নাহ! কোন গড নেই, যদি থাকতো তাহলে এরকম ঘটবে কেন?” এভাবে তিনি মানবতার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন- যদি সত্যিই একজন প্রভু থেকে থাকে আমাদের কেন তিনি সৃষ্টি করলেন? কেন তিনি অন্যায় সৃষ্টি করলেন? কেন তিনি সবকিছু ভাল হিসেবে সৃষ্টি করেন নি?
তিনি তার কৈশোর অতিক্রম করেন ষাট সত্তরের দশকে। আর তখন আমেরিকাতে বর্ণবাদ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল, রাস্তায় রাস্তায় গ্যাং ফাইট চলত, তিনি নিজেও কোন কোনটার সদস্য ছিলেন। এক প্রেসিডেন্টের ইম্পেচমেন্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, আরেক প্রেসিডেন্টের খুন হওয়াসহ নানা কারণে সে সময় দুনিয়াতে খুবই বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছিল, নাপাম বোমা নিক্ষেপ করে শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তারা কী অন্যায় করেছে? তাদেরকে কেন জ্যান্ত পুড়ে মরতে হবে।
এই সব জঘন্য কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে তার এ উপলব্ধি আরও দৃঢ় হল যে পৃথিবী ভয়ংকর রকমের দুর্নীতিগ্রস্ত, চরম অশুভ এবং মারাত্মক রকমের হানাহানি আর রক্তারক্তিতে নিমজ্জিত। এটা বুঝি একজন ভালবাসাপূর্ণ আর দয়ালু প্রভুর সৃষ্ট ব্যবস্থাপনা! এটা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। তিনি এটা মিলাতে পারলেন না।
তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেল। তিনি এখন ২৭ বছরের এক যুবক। কোন এক ব্যক্তি তাকে এক কপি পবিত্র কুরআন উপহার দেন। কখনো খুলে দেখেন নি। একদিন তিনি বাসায় বসে আছেন, কিছুটা উদাস, পড়ার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি পবিত্র কুরআনের বইটি খুলে পড়া শুরু করলেন। সূরা ফাতিহা থেকে পড়া শুরু করলেন, বাকারাও পড়তে লাগলেন। মনে রাখবেন, তিনি ছোট বেলায় ক্যাথলিক স্কুলে গিয়েছিলেন; তিনি নবীদের গল্প জানতেন আমি আগে আপনাদের যেভাবে বলেছিলাম সেভাবে।
তো, তিনি পড়ছিলেন… এক জায়গায় পৌঁছে ভাবলেন – নিশ্চয়ই লেখক (তিনি জানতেন না যে এটা আল্লাহর কালাম) এখানে ভুল করেছেন। তিনি এখানে কী বলছেন? আমার মনে হয় লেখক এখানে সঠিক বিষয়টা বুঝতে ভুল করেছেন। বিষয়টা হল আমাদেরকে এই পৃথিবীতে অভিশাপ হিসেবে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু লেখক এখানে বলছেন – তিনি একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন যার এই পৃথিবীতে ভাল কাজ করার কথা। কী? এটা তো সুখী কোন গল্প নয়। এখানে কেন গল্পটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে? আমি বুঝলাম না। তিনি ভাবলেন- লেখক মনে হয় বিষয়টা ভালভাবে জানেন না। তাই তিনি কুরআনের অনুবাদটি বার বার পড়তে লাগলেন। একই গল্প তিনি বিশ ত্রিশ বার পড়লেন। তিনি প্রতিবার নতুন নতুন জিনিস পাচ্ছিলেন যা তার পূর্ব ধারণার সাথে জট পাকাতে লাগলো। তিনি বলেন – আল্লাহ বলেছেন তিনি পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠাতে চান, কিন্তু ফেরেশতারা বলল… কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ফেরেশতারা কী বলল? মানুষ পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে এবং রক্তপাত করবে। হ্যাঁ, ঠিকই তো। আমিও তাই বলতাম। কেন এই মানুষ সৃষ্টি? কারণ এ বিষয়গুলোই তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। তো, তিনি পড়ছিলেন আর ভাবলেন- ওয়াও, ফেরেশতারা তো ভালই। লেখক গল্পটি বলছেন…মনে হয় লেখক আমার প্রশ্নেরও জবাব দিবেন। কারণ ফেরেশতারা আমার মত একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে- কেন আপনি মানুষ সৃষ্টি করবেন? ফেরেশতারা আরও বলল- আমরা আপনার প্রশংসা করি। (অবচেতন মনে তিনি ভাবছেন) ঠিকই তো, আপনি কেন সবাইকে ফেরেশতা বানাচ্ছেন না? কেন পৃথিবী বানাতে হবে? জান্নাত তো আছেই। আপনার যদি কিছু করতেই হয় আরও ফেরেশতা তৈরি করেন। এটা তো ভালই কাজ করছে। আপনাকে কেন এই জটিল প্রজাতি সৃষ্টি করতে হবে?
তারপর আল্লাহ বলেনঃ “আমি জানি, যা তোমরা জানো না।” তিনি ভাবতে লাগলেন আল্লাহ কী জানেন যা আমরা জানি না। তিনি তার বক্তব্যে বলেনঃ আমি বইটি পড়তে লাগলাম আর অবচেতন মনে লেখকের সাথে সংলাপে মিলিত হলাম। আর তখনো আমি একজন নাস্তিক। আপনি কী জানেন? দয়া করে বলুন। কারণ সারা জীবন ধরে আমি এর জবাব পাইনি। আমি জানতে চাই। তারপর কুরআন জবাব দিল তিনি আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। অতঃপর ফেরেশতাদের সামনে তাঁকে উপস্থাপন করলেন। আমি সংক্ষেপে বলছি, কারণ পরে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। আমি আপনাদের এখন সারাংশ দিচ্ছি।
আল্লাহ আদমকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। তিনি আদম (আ) কে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। তারপর বললেন- আমাকে এসব কিছুর এবং এসব মানুষের নাম বল। তারা বললেন- আমরা পারবো না, আমাদের তো এ বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই। অতঃপর আল্লাহ আদম (আ) কে নামগুলো বলে দিতে নির্দেশ দিলেন। আদম (আ) কোন ধরণের সমস্যা ছাড়াই সব নাম বলে দিলেন। স্পষ্টত আল্লাহ বলছেন যে, হ্যাঁ মানুষ হয়তো বিশৃঙ্খলা এবং রক্তপাত করতে সক্ষম; কিন্তু আমি মানব জাতিকে এমন কিছু দান করবো যা তোমাদের ফেরেশতাদের নেই। আমি তাঁকে শিক্ষা দিব। ‘আল্লামা আদাম’ আমি আদমকে শিক্ষা দিব আর সে শিখবে। ফলে তাঁর জ্ঞান থাকবে আর এ জ্ঞান তাঁকে মুক্তি দিবে। সে আশ্চর্যজনক সব কাজ করতে সক্ষম হবে।
কারণ আল্লাহ প্রথম যে জিনিসটির কথা উল্লেখ করছেন সেটা হল? জ্ঞান, তাঁর বুদ্ধিমত্তা, তাঁর কৌতূহল, পৃথিবীতে তাঁর আবিষ্কারের সক্ষমতা। এ পর্যায়ে এসে প্রফেসর ভাবতে লাগলেন… আমাদের তো কোন প্রশ্ন না করে শুধু বিশ্বাস করার কথা! আপনি প্রশ্ন না করলে বা অন্বেষণ না করলে শিখতে পারবেন না। মানব জাতি এ জন্য শ্রেষ্ঠ কারণ তারা শিখতে পারে?? সত্যিই? এটাই তাহলে সেই সিক্রেট যা ফেরেশতারা জানে না, আল্লাহ জানেন? সেই সিক্রেটের অংশ হল মানুষ শিখতে পারে এবং কলম দিয়ে সেই শিক্ষাকে পরবর্তী বংশধরের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে যেন আরও অন্বেষণ করতে পারে, খুঁজতে পারে??
তারপর তিনি বলেন, আমি আরও পড়তে লাগলাম। তিনি এখানে চমৎকার যা পেলেন …। আল্লাহ আদম (আ) কে কী বলেছিলেন? তোমার স্ত্রীকে নিয়ে জান্নাতে বসবাস করতে থাকো কিন্তু এই গাছটির নিকটে যেও না। গাছের পাশে অগ্নিগর্ভ কোন গার্ড দাঁড়ানো নেই, ভাল গাছ বা মন্দ গাছের কোন উল্লেখ নেই; শুধু একটা গাছ। আমাদের মুফাসসিরগণ এ বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন যে এটা আসলে কোন ধরণের গাছ ছিল, এটা কি একটা আনারস গাছ ছিল? আল্লাহ যদি আমাদের জানাতে চাইতেন তাহলে তিনি কী করতেন? তিনি বলে দিতেন। তিনি শুধু আমাদের জানাতে চাইলেন যে এটা একটা গাছ ছিল। এতোটুকু জানাই যথেষ্ট।
ঘটনা দেখে মনে হয় না যে এটা কোন বিশাল ব্যাপার ছিল। দেখ, এটা শুধু একটা নিষেধাজ্ঞা; এটা একটা পরীক্ষা। আমি শুধু চাই তোমরা এই গাছটির নিকটবর্তী হয়ো না। এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করো না। যদি গাছটির নিকটবর্তী হও তাহলে তুমি জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। এখানে এমন কিছু নেই যে, যদি তুমি তা কর তাহলে তুমিই হবে অন্যায়কারী, আমি তোমাকে আগুনে জ্বালাব, কষ্ট দিব, শাস্তি দিব, অভিশাপ দিব – এমন কিছুই নেই। তিনি ভাবতে লাগলেন – আরে! এই প্রভু তো ক্রোধান্বিত নন! কেন তিনি রাগান্বিত নন? তিনি পড়ছিলেন আর ভাবছিলেন – আরে এই প্রভুর তো এমন হওয়ার কথা ছিল যে তিনি আদমের অন্তরে দোজখের ভয় ঢুকিয়ে দিবেন যেন আদম গাছের নিকটবর্তী না হন। কিন্তু তিনি শুধু বলছেন – এই শোন, এই গাছটির নিকটে যেও না। মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তিনি খুবই শীতল।
অবশেষে শয়তান যখন ওয়াসওসা দিল সে শুধু একজনকে দিল না, সে উভয়কে দিল। এই ব্যাপারে আল্লাহ কী বলেছেন? আল্লাহ বলেছেন, সে উভয়কে দিয়ে সামান্য ভুল করালো। প্রফেসর বলেন- আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল যার দরুণ এই পৃথিবীতে আমরা অভিশপ্ত জীবন যাপন করছি (খ্রিস্টানদের মতে); আর এ বই এটাকে বলছে সামান্য ভুল! সামান্য ভুলের উদাহরণ হল – আমি ভুলক্রমে আপনাদের করো জুতা পরে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলাম। সেটা একটা সামান্য ভুল। সেটা সামান্য ভুল! না, এটা সামান্য ভুল নয়। মনে হয় এটা একটা বাজে অনুবাদ। তারপর তিনি বলেন – আমি আমার আরব বন্ধুকে পেলাম। তুমি কি এটা শাব্দিক অনুবাদ করে দিতে পারবে? আরব বন্ধু বলেন- ফা- অতঃপর, আজাল্লাহুমাশ শায়তান- শয়তান তাদেরকে দিয়ে করালো … তিনি বলেন- কী করালো, কী করালো? আজাল্লা অর্থ কী?
– সামান্য ভুল।
– সামান্য ভুল? সত্যিই?
তিনি অবাক হয়ে গেলেন। কারণ এটা বাইবেলে খুবই বিরাট ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর কুরআনের মতে, শয়তান তাদেরকে দিয়ে সামান্য একটা ভুল করালো। আপনি যদি এই পাপকে অন্য পাপের সাথে তুলনা করেন তাহলে কী দেখেন? ফেরেশতারা মানুষের কোন ধরণের পাপ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন? ফেরেশতারা কি এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, আদম (আঃ) গাছ থেকে ফল খেয়ে ফেলবেন? তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন মানুষের ফেতনা ফ্যাসাদ নিয়ে, খুন, গণহত্যাসহ সব রকমের অপকর্ম নিয়ে। এসব অপকর্মকে গাছ থেকে ফল খাওয়ার সাথে তুলনা করুন। দিনশেষে মানুষের বুদ্ধিমত্তার যে কোন বিচারে এটাকে সামান্য ভুলই মনে হয়। এটা একটা সামান্য ভুল।