একজন বিশ্বাসীর রাত্রিযাপন (১ম পর্ব)

মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সবার জন্য রাতের সময়টা স্পেশাল। একটা বিষয় মনোবিজ্ঞানীরা প্রায় বলে থাকেন – রাতের সময়টা হলো আধ্যাত্মিক সময়। এই সময়টাতে মানুষ তার নিজের মনের অনেক কিছু শেয়ার করতে চায়। তারা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ থাকে। ইসলাম কী করে, ইসলাম এই সময়টার সুযোগ গ্রহণ করতে বলে। অন্যরা যখন বিভিন্ন পাপ কর্ম করে এই সময়টা কাটায়, বিশ্বাসীরা তখন এই আধ্যাত্মিক, এই আবেগময় সময়টা তাদের রবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত করে। স্কলাররা প্রায় বলে থাকেন, রাতের কাজ একজন ব্যক্তির ভালোবাসার সাক্ষ্য দেয়। সুতরাং, মানুষ যে বিষয়টা বেশি ভালোবাসে, সাধারণত সে বিষয়টা রাতের জন্য উৎসর্গ করে। যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলো, মৌজ মাস্তি করা, যতবেশি সম্ভব আনন্দ লাভ করা, তারা তাদের রাতের সময়টা এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যয় করে। অন্যদিকে, যদি একজন ব্যক্তির একমাত্র লক্ষ্য হয় আখেরাত এবং আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, তাহলে তিনি তার রাতের সময়টা এই আখেরাত পাওয়ার উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবেন। এবং তার রাতের সময়টা আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ ۗ – “কিন্তু যারা মু’মিন আল্লাহর সঙ্গে তাদের ভালবাসা প্রগাঢ়।” ইমাম হাসান আল বসরী (র)…. আমি প্রায়শ ইমাম হাসান আল বসরী (র) এর উদৃতি দিয়ে থাকি। কারণ তিনি ইসলামের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ, একজন তাবেয়ী। তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক দিকের উপর বেশ গুরুত্বারোপ করেছেন। আমি মনে করি, তাঁর কথাগুলো যদি আমাদের সময়ে আমরা পালন করি, তাহলে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারবো। তো, এই মহান ইমাম হাসান আল বসরী (র) কে কিছু মানুষ জিজ্ঞেস করেন – ” কেন আমরা ক্বিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে পারি না? তারা আরো বলেন – ” আমরা রাতে নামাজ পড়তে উঠার জন্য অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু আমাদের জন্য এটা অনেক কঠিন মনে হয়।” তখন তিনি জবাবে বলেন – ” তোমাদের পাপের কারণে এবং...

আল্লাহর কাছে কীভাবে ক্ষমা চাইবেন?

এখন এই ক্ষমা চাওয়াটা দুইভাবে হয়ে থাকে। জিহবার মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়া এবং অন্তরের মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়া। মানুষ সাধারণত নিজের পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকে। আমি যদি কোনো কারণে আপনার সমালোচনা করি…যেমন আমি কাউকে বললাম – ”এই যে, আমি আপনাকে অমুক কথা বলতে শুনেছি। কেন আপনি এটা বলেছেন?” সে তৎক্ষণাৎ হয়তো বলে উঠবে – ”আমি এমনটা বোঝাতে চাই নি, আপনি জানেন না আমি কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি! এক্সকিউজ মি, আপনি তো পুরো ঘটনাটা জানেনই না।” সুতরাং কেউ আপনাকে যদি বলে, ভাই আমি আপনাকে এটা এটা করতে দেখেছি। আপনি সাথে সাথে নিজের পক্ষে যুক্তি দিতে শুরু করেন, আত্মরক্ষামূলক হয়ে উঠেন। بَلِ الْإِنسَانُ عَلَىٰ نَفْسِهِ بَصِيرَةٌ – وَلَوْ أَلْقَىٰ مَعَاذِيرَهُ – মানুষ নিজের সম্পর্কে সু ধারণা পোষণ করে। তারা প্রচুর অজুহাত দেখায়। আপনি যদি আসলেই আল্লাহর ক্ষমা চান। আপনাকে নিরিবিলি একটা সময় খুঁজে পেতে হবে … যদি আরবিতে দোয়া করতে না পারেন কোনো সমস্যা নেই। আপনি শুধু পাঞ্জাবি, বাংলা, বাহাসা, বা উর্দু জানেন, কোনো ব্যাপার না, আপনি আপনার নিজস্ব ভাষাতেই আল্লাহর সাথে কথা বলুন। আন্তরিকতার সাথে আপনার অপরাধগুলো স্বীকার করে নিন। কোনো অজুহাত দেখবেন না। এইরকম করতে পারা আসলেই অনেক কঠিন। কারণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও আমরা নিজের সাথে মিথ্যা বলি। নিজেকে এভাবে প্রবোধ দেই – ”আমি আসলে অতো খারাপ না। আমি যা করেছি তার কারণ আছে। আমি অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।” যখন আপনি আল্লাহর সামনে দাঁড়াবেন, নিজের কাজের বৈধতা দেয়ার কথা ভুলে যান। কারণ যেসব অজুহাতের মাধ্যমে আপনি আপনার কাজের বৈধতা দিতে চান, তিনি ইতিমধ্যে তার সবগুলোই জানেন। আল্লাহ জানেন আপনি কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি জানেন এটা কঠিন সময় ছিল, তিনি জানেন অমুক অমুক বিষয় আপনাকে সম্পূর্নরুপে গ্রাস করে ফেলেছিলো। ” ইয়া রব, আমি অনেক চাপের মধ্যে ছিলাম তাই...

যেভাবে শিরকের দরজা খুলে যায়

আমি এখন আপনাদের এমন একটা বিষয়ের কথা বলবো যা আমাদেরকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত রাখে। বিষয়টা একজনের কাছে কতটুকু প্রত্যাশা করা হয় তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিছু কিছু মানুষ মনে মনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যায় – “আমি সারা জীবন ধরে অসংখ্য পাপে নিমজ্জিত ছিলাম। আল্লাহ মনে হয় আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না।” কোনো কোনো মানুষ এমনকি এতদূর পর্যন্ত চলে যায় যে – বলে উঠে, “আল্লাহ আমাকে ঘৃণা করে।” আমি নিজে তাদের বলতে শুনেছি। “আল্লাহ আমাকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ আমার উপর খুবই রাগান্বিত। কারণ আমি বহু অপকর্ম সাধন করেছি। আমি জানতাম – আল্লাহ এই এই কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু তারপরেও আমি করেছি। শুধু একবার নয়, বহুবার এই খারাপ কাজগুলো করেছি। সুতরাং আল্লাহর ভালো মানুষের তালিকায় আমি নেই। আমার নামাজের কোনো দাম নেই।” মানুষ যখন নিজের সম্পর্কে এই রকম ধারণা পোষণ করে, তখন সে কী করে জানেন? “আমি তো খুবই খারাপ মানুষ। আপনি কি আমার জন্য একটু দোআ করতে পারবেন? কারণ আমি ইতিমধ্যে দোআ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি, এখন আপনাকে আমার জন্য দোআ করতে হবে। কারণ আমি আশা করছি, আল্লাহ অন্তত আপনার দোআ কবুল করবেন। এতে হয়তো আমার একটা সুযোগ তৈরী হতে পারে। কারণ আমি? আমার কথা তিনি শুনবেন না। আপনার তো আল্লাহর সাথে ভালো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়। তাই দোআ টা আপনিই করুন।” আপনাদেরকে আবার একটু পেছনে নিয়ে যাই। নূহ (আ) কাদের কাছে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার এই প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন? নূহ (আ) কি এমন মানুষদের নিকট এই প্রস্তাব তুলে ধরেন যারা সারা রাত মসজিদে কাটাতো? প্রতিবছর হজ্জ্ব পালন করতে যেত? রোজা রাখতো এবং অন্য আরো সৎ কাজ করতো? নূহ (আ) ক্ষমা পাওয়ার এই প্রস্তাব তুলে ধরেন ইতিহাসের অন্যতম একটি বিদ্রোহী সম্প্রদায়ের প্রতি। যারা...

আখিরাতের জন্য পরিকল্পনা করা

জানেন, আমরা এটা থেকে কি শিখলাম? কোন কিছুকে বড় করে দেখলেই সেটা বড় ব্যাপার হয়ে যায়। কোন কিছুকে ছোট করে দেখ তাহলেই সেটা সামান্য মনে হবে। জানেন, এই আয়াতে আখিরাতকে বড় এবং দুনিয়াকে ছোট করে দেখানো হয়েছে।পুরো আয়াতটা এটা নিয়েই। দুনিয়াতে আমরা জীবন যাপন করবো। আমাদের ক্যারিয়ার হবে।আমাদের শিক্ষাগত অর্জন থাকবে।আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এই সব কিছুই জীবনে থাকবে।কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানো এই সব কিছু ক্ষণস্থায়ী। সব কিছুই। একদিন আসবে যেদিন এক জমায়েত হবে।এবং সেদিন তারা নামায পড়বে। আর সেদিন তারা একটা ঘোষণা দিবে।যে একটা জানাযা হবে। এবং এই ঘোষণাটা একদিন হবে আমার জন্য এবং একদিন হবে আপনার জন্য। এটা হতে যাচ্ছে এবং একদিন মানুষ আমাদের জন্য জানাজার নামায পড়বে। এবং ততক্ষনে আমরা চিরকালের জন্য চলে গেছি। এবং এটা শীঘ্রই ঘটবে, দেরীতে নয়। আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের জীবনের অনেকখানি তো ইতোমধ্যেই কেটে গেছে। সুতরাং এমন নয় যে সেই দিনটা থেকে আমরা দূরে যাচ্ছি, বরং আমরা সেই দিনের আরো কাছে পৌছাচ্ছি। তাই যত তাড়াতাড়ি আমরা এটা আত্মস্থ করি যে, আল্লাহর কাছে যা আছে তা তুলনামূলক ভাবে ভালো। কারন যে কোন ভাবেই হোকনা কেন আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। তাহলে আমরা নিজেরা নিজেদেরই উপকার করব । যদি আমরা শুধু এটা শিখতে পারি যে কিভাবে সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হয়। যেমনটা আমি বললাম যে আমরা ১০ বছরের পরিকল্পনা করি, ১৫ বছরের পরিকল্পনা করি।কিন্তু আমরা আখিরাতের কথা চিন্তাই করিনা। তাহলে আখিরাতের কথা কিভাবে ভাবা উচিত? কিভাবে আখিরাতের জন্য বাস্তবতা ভিত্তিক পরিকল্পনা করা যায়? আখিরাতের জন্য আমরা ১০ বছরব্যাপী, ১৫ বছরব্যাপী পরিকল্পনা করিনা। আমরা এর জন্য দৈনন্দিন পরিকল্পনা করি। এটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী লক্ষ্য নির্ধারণ করা নয়। এটা আজকের দিনটা আপনি কিভাবে ব্যয় করলেন তার সাথে সংশ্লিষ্ট। আপনি তার পরে কি করতে যাচ্ছেন এটা তার সাথে...

উপাসনা না দাসত্ব?

আমি আপনাদেরকে আরবি শব্দ “ইবাদাহ বা এর মাছদার উবুদিয়া” এর অর্থ বোঝাতে চাই। শব্দটি দ্বারা দুটি জিনিস বোঝায়, যদি আমি এর যেকোনো একটি অর্থ ব্যবহার করে অনুবাদ করি তাহলে অনুবাদটি হবে অসম্পূর্ণ। এটা ক্লাসিকাল আরবির বিপরীতে ইংরেজি বা বাংলার সীমাবদ্বতা। ক্লাসিকাল আরবির একটি শব্দ দিয়ে একই সময়ে অনেকগুলো অর্থ প্রকাশ করা হত। যদি আমরা এই ধারনাটি (ইবাদা শব্দটি) আংশিক বাংলা অর্থ দিয়ে অনুবাদ করি, তাহলে বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। যে দুটি পদ আরবি শব্দ ইবাদার পরিপূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে তাহলো – উপাসনা এবং দাসত্ব। অধিকাংশ সময় আমরা যেকোনো একটি অর্থ গ্রহণ করি। বাংলায় দুটি আলাদা বিষয়, কিন্তু আরবি একটি শব্দ ইবাদা দ্বারাই উভয়টি বোঝায়। সুতরাং যখন রাসুল (স) বলেন, ‘লা আ’বুদু মা তা’বুদুন’ – এর অর্থ শুধু এটা নয় যে, আমি উপাসনা করব না, বরং এর অর্থ এটাও যে, আমি গোলাম হব না , আমি দাস হব না। সংক্ষিপ্তভাবে আমি আপনাদেরকে উপাসনা এবং দাসত্বের পার্থক্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব। যখন মাগরিবের নামাজের সময় হয়, আমরা আল্লাহর উপাসনা করি। আবার যখন এশার নামাজের সময় হবে, আমরা উপাসনা করব। কিন্তু এই দুই নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে আমরা কী? আল্লাহর দাস। যখন আপনি ঘুমাচ্ছেন আপনি উপাসনা করছেন না, কিন্তু তখনও আপনি আল্লাহর একজন দাস। যখন আপনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন, গাড়ি চালিয়ে কাজে যাচ্ছেন, দাঁত ব্রাশ করছেন, নাস্তা করছেন, গাড়ি পার্ক করছেন – যদিও এই সময় আপনি কুরআন তিলাওয়াত করছেন না বা কোনো উপাসনার কাজ করছেন না – কিন্তু এই সময়েও আপনি আল্লাহর একজন দাস। অন্য কথায় উপাসনা হলো – কিছু সুনিদৃষ্ট কাজের নাম। রোজা রাখা, নামাজ পড়া, হজ্জ পালন করা, কুর’আন তিলাওয়াত করা, দান করা – এইসব কাজ হলো উপাসনা। কিন্তু একজন দাস সবসময়-ই একজন দাস। সে এই কাজগুলো পালন করুক আর...