রাগকে নিয়ন্ত্রনে রাখুনঃ

أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
بسم الله الرحمن الرحيم

فَمَا أُوتِيتُم مِّن شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَا عِندَ اللَّهِ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ لِلَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ

অতএব, তোমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ মাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী তাদের জন্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও তাদের পালনকর্তার উপর ভরসা করে।

وَالَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ وَإِذَا مَا غَضِبُوا هُمْ يَغْفِرُونَ

যারা বড় গোনাহ ও অশ্লীল কার্য থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধাম্বিত হয়েও ক্ষমা করে,

সুরা আস শূরা আয়াত ৩৬ ও ৩৭

সকল প্রশংসা আল্লাহর। তার রসুল(স) এর উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আবারও কুরআন উইকলিতে, একটি ছোট্ট দৃষ্টি আকর্ষনী। গতবার ৪-৫ মিনিট বলেও ৭ মিনিট সময় নিয়েছিলাম। এবার কি করব জানি না। আমি সংক্ষিপ্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আল্লাহর নামে শুরু করছি। আজকে আমি আপনাদের মেজাজ ও রাগ নিয়ন্ত্রন সম্পর্কে বলতে চাই। কিন্তু আমি নিজের কোন মনগড়া বক্তব্য দিতে চাই না। বরং আল্লাহ্‌ কিভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং ব্যাপারগুলোকে সংশ্লিষ্ট করেছেন তাই উপস্থাপন করবো। যেন আপনারা একেবারেই ভিন্ন এবং নৈর্ব্যক্তিক আঙ্গিকে ব্যাপারটি চিন্তা করতে পারেন। প্রথমত, আল্লাহ্‌ বলেছেন… “তোমাদের এই দুনিয়াতে যা কিছু দেয়া হয়েছে সবকিছুই পার্থিব জীবনের ব্যবহার্য সামগ্রী,” অন্য কথায়, এগুলো তাৎপর্যহীন, আখিরাতের জীবনে যা আসছে তার কাছে এগুলো কিছুই না। এবং আমরা এ গুলো নিয়েই পড়ে আছি। আমরা মনে করি যখন আমরা কিছু পাই বা হারিয়ে ফেলি অথবা খারাপ কিছু ঘটে, এটাই বুঝি দুনিয়ার সবকিছু। এখানেই দুনিয়ার শেষ নয়। আপনাকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে ব্যবহার্য সামগ্রী- “মা-তা’হ”। “মা-তা’হ” অর্থ “এমন কিছু যা আপনি ব্যবহার করেন কিন্তু উপভোগের প্রয়োজন নেই”। প্রাচীন আরবরা “মা-তা’হ” নামে একধরনের ব্রাশ বাসন মাজতে ব্যবহার করতো। এমন জিনিস যা ব্যবহার্য কিন্তু উপভোগ্য না, ঝাড়ু, বেলচা, কাঁটা চামচ- এগুলোই আরবীতে “মা-তা’হ”। আল্লাহ্‌ বলছেন, সমস্ত পৃথিবী, এর সবকিছুই “মা-তা’হ”। আপনাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে সবই। মোটকথা, আপনার জন্য এমন কিছু যা এখন শুধুই বৃহৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন, উপভোগ করার বস্তু হচ্ছে আখিরাতের জীবন। তিনি বলেন, “আল্লাহর কাছে যা আছে তা আরও উত্তম।” আপনারা হয়তো অবাক হচ্ছেন, আমি এখনও রাগ নিয়ে কিছু বলছি না কেন? এগুলো কেন বলছি? আসলে এগুলো সবই আল্লাহর ভাষ্যনুযায়ী সম্পর্কিত। আপনাদের ব্যবহার্য সামগ্রী হিসেবে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা এখানে, এই ক্ষু্দ্র দুনিয়ায় ব্যবহারের জন্য। এই ক্ষুদ্র আবদ্ধ জীবনে এই সামগ্রীগুলো এখানেই ব্যবহারের জন্য। আর আল্লাহ্‌ তার নিজের কাছে যেগুলো রেখে দিয়েছেন সেগুলো উত্তম। প্রথমত, সেগুলো উত্তম। এবং (দ্বিতীয়ত) সেগুলো চিরস্থায়ী। সুতরাং এই পৃথিবীতে আপনি যা পেয়েছেন আল্লাহ্‌র নিকট তার চেয়ে উত্তম সামগ্রী রয়েছে। আপনার যদি একটা বাড়ি থাকে আল্লাহর কাছে উত্তম বাড়ি আছে, আপনার এখানে পোশাক আছে, আল্লাহ্‌র কাছে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট পোশাক আছে (পরবর্তী দুনিয়ায় আপনার জন্য), আপনার বাহন আছে, আল্লাহ্‌র আপনাকে আরও চমৎকার বাহন দেবেন। আপনার যদি যৌবন, স্বাস্থ্য, শক্তি অথবা সামর্থ্য থাকে, আল্লাহ্‌ আপনাকে এগুলোর চেয়েও উত্তম কিছু দেবেন। আপনার যে সঙ্গী আছে, আল্লাহ্‌ আপনাকে আরো উত্তম সঙ্গী দেবেন।

আল্লাহ্‌র কাছে আপনার জন্য যা কিছু রয়েছে সবগুলোই আরো উৎকৃষ্ট। সুতরাং দুনিয়ার এই জিনিসগুলোতে জড়িয়ে যাবেন না। এবং মনে রাখবেন জিনিসগুলো যত বড়ই হোক না কেন আল্লাহ্‌র কাছে আপনার জন্য যা আছে তা এর চেয়ে উত্তম। কিন্তু তিনি আরেকটি বিশেষন যোগ করেছেন, বলেছেন, “আব-ক্ব” তুলনামূলকভাবে আরো দীর্ঘস্থায়ী। অন্যকথায়, আপনার এখন যা আছে তা ক্ষনস্থায়ী। আপনার একটা বাড়ি আছে, ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া শুরু করবে। আপনার স্বাস্থ্য ভালো, তা নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি শক্তিশালী, একসময় দূর্বল হয়ে যাবেন। আপনার সুন্দর গাড়ি আছে, একসময় সমস্যা দেখাবে। আপনার বন্ধু আছে, হারিয়ে যাবে, অন্য শহরে চলে যাবে কিংবা জীবিকার তাগিদে অন্যত্র চলে যাবেন। এই জীবনে আপনার যাই থাক না কেন চিরস্থায়ী নয়। এ কারনেই আল্লাহ্‌ বলেন, “ তুমি এমন কিছুর জন্য কেন চেষ্টা করবে না যা উত্তম ও চিরস্থায়ী?” কিন্তু এটা কাদের জন্য? যারা আসলেই মুমিন। আল্লাহ্‌ যখন “মুমিন” সম্বোধন করেন তখন শুধু সাধারনভাবে বিশ্বাসী বোঝায় না যদিও এটাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এটা ঐ আয়াতের জন্যই। যারা আসলেই বিশ্বাস করে যে দুনিয়ার এই সামগ্রীগুলো পরবর্তী জীবনের কাছে কিছুই না। এটা তাদের জন্যই। তারা প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করে। তারা প্রচন্ডভাবে তাদের প্রভুর উপর বিশ্বাস রাখে। এর মানে হলো এটা প্রকৃত অর্থেই বিশ্বাস করতে হলে আপনাকে আল্লাহ্‌র উপর অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে তিনি পরবর্তী জীবনে আপনাকে এমন কিছু দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা আপনি কখনোই দেখেননি বা স্পর্শ করেননি এমনকি গন্ধও নেন নি, শুধু শুনেছেন। তাঁর কথার উপরে বিশ্বাস করাই যথেষ্ট। এর জন্য শুধুই বিশ্বাসের প্রয়োজন। তিনি বলেছেন তাদের জন্য… যা তারা পরবর্তী জীবনে পাবে তা উত্তম এবং চিরস্থায়ী কিন্তু এর জন্য বিশ্বাস ও আল্লাহ্‌র উপর ভরসা থাকা লাগবে। এর পর তিনি বলেন এরা হল সেই লোকেরা যারা আখিরাতকে দুনিয়ার উপরে প্রাধান্য দেয়। যারা বোঝে যে এগুলো শুধুই ব্যবহার্য সামগ্রী। তারা কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে। এখানে আরেকটা ব্যপার চলে আসে- সগীরা ও কবীরা গুনাহ। আপনার প্রধান কাজ হলো কবীরা গুনাহ থেকে দূরে থাকা। আপনি যখন কবীরা গুনাহ করেন, আপনি সব সময় বলতেই থাকেন, “ওহ! আমার ছোট খাটো গোনাহ করা উচিৎ না”। আপনি আসলে বড় গোনাহ থেকে বিরত থাকতে চাচ্ছেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিকে কাজ করতে হবে। এর পরে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, “সব ধরনের বেহায়াপনা হতে”। এটা বেহায়াপনা নিয়ে বক্তব্য না, ‘রাগ নিয়ন্ত্রন’ নিয়ে। অথচ এখন পর্যন্ত আমি রাগ নিয়ন্ত্রন নিয়ে কিছুই বলছি না, কিভাবে সম্ভব! আল্লাহ্‌ বলছেন কবীরা গুনাহসমূহ থেকে দূরে থাক এবং দূরে থাক সব ধরনের কঠোরতা, অভদ্রতা আর নির্লজ্জতা হতে। এর পর তিনি বলছেন “ যখন তারা রেগে যায়…” আমি এখনও বাক্যটা শেষ করি নি।

কিন্তু এখন তিনি ‘রাগ’ শব্দটি এনেছেন। দেখলেন কোথায় রাগ শব্দটি আনলেন? প্রথমে তিনি বলে নিলেন, এই দুনিয়া আখিরাতের তুলনায় কিছুই না… কারন এই দুনিয়াই যদি সব হয়, ভুল কিছু হলেই আপনি রেগে যাবেন। কিন্তু এই দুনিয়া যদি আখিরাতের তুলনায় কিছুই না হয় তবে কিছু পেলে বা হারালে অথবা ভুল হলে আপনার কাছে খুব বড় কিছু মনে হবে না। আপনি বলতে পারবেন ইন্না লিল্লাহি… রাজিউন (নিঃসন্দেহে আমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছি আর তার কাছেই ফিরে যেতে হবে)। মোটকথা আপনি সহজেই শান্ত থাকতে পারবেন। এটা ঘটবে যখন আপনি আত্মস্থ করবেন প্রথম শিক্ষাটা। দ্বিতীয় বিষয়টি হল আল্লাহ্‌ যেমনটি বলেছেন বড় গুনাহ হতে বিরত থাকা। তিনি বিশেষভাবে একটিকে উল্লেখ করেছেন ‘সব ধরনের নির্লজ্জতা’। নির্লজ্জতা কি? আপনার উত্তেজনা, আবেগকে নিয়ন্ত্রনের অক্ষমতা। আপনার উত্তেজিত হলেন, তা প্রকাশ করে ফেললেন। আপনার কোন কিছু দেখার তাড়না জাগলো, আপনি বিরত না থেকে তাকিয়ে থাকলেন। আপনার কোন কোন জায়গায় যাওয়ার জিদ চাপলো, আপনি না পেরে চলে গেলেন। আপনার কারো সাথে যোগাযোগের তাড়না জাগলো, আপনি বিরত থাকলেন না। এটা আল্লাহকে অখুশী করবে কিনা তা আপনার মাথায় এলো না। আপনি পারলেন না এই তাড়নাগুলো নিয়ন্ত্রন করতেন। আপনি যদি এই তাড়না ও আবেগগুলোর উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেন তাহলে যখন আপনি ক্ষিপ্ত হবেন তখনও আপনি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়বেন। তাই যে ব্যক্তি নির্লজ্জ তার নিজের মেজাজের উপরও নিয়ন্ত্রন নেই। কিন্তু যে তার লজ্জা সামলে রাখতে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারে যা আরও বেশি শক্ত। কারন আমাদের সবার সবসময়ই উত্তেজনা আছে। আমাদের সবসময় তা সামলে রাখতে হয়। আপনি যদি তা পারেন ক্ষিপ্ত হয়ে হওয়া থেকে বিরত থাকা আরও সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ্‌ আরও বলেছেন। আমি এখনও বলিনি তাই না? আমি বলিনি তারা যখন রাগান্বিত হয় তখন শান্ত হয়ে যায়। বরং তিনি বলেছেন, “তারা যখন রেগে যায় তখন মাফ করে দেয়”। এখন রেগে যাওয়ার ও শান্ত হওয়ার একটা ব্যাপার আছে। এটা খুব কঠিন। চিন্তা করুন, কেউ আপনাকে খুব বিরক্ত করছে। আল্লাহ্‌ বলেছেন যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং আখিরাতকে দুনিয়ার উপরে স্থান দেয়, তারা যখন খুব রাগান্বিত হয় তখন ক্ষমা করে দেয়, সুবহানাল্লাহ। আমরা শান্ত অবস্থাতেই ক্ষমা করি না! আল্লাহ্‌ বলছেন যদি আপনি সত্যিকার অর্থেই এমন মানুষে পরিনত হতে চান যারা আখিরাতকে প্রাধান্য দেয় তাহলে রাগান্বিত অবস্থাতেও আপনার ক্ষমা করা শিখতে হবে। কি চমৎকার এক মানদন্ড তিনি দিয়েছেন! যদিও এটা অত্যাবশ্যক নয়। এটা সর্বোচ্চ সামর্থ্য সম্পন্ন লোকদের জন্য। আল্লাহ্‌ আমাদের সেই তাওফিক দিন। এর পরের আয়াতে তিনি বলেন

আপনি রেগে যেতে পারেন, প্রতিশোধও নিতে পারেন। যদি আপনার সাথে খারাপ কিছু করা হয়, আপনি তা ফিরিয়ে দিতে পারেন, কেউ আপনাকে চড় দিলে আপনিও তাকে চড় দিতে পারেন। এর অনুমোদন ইসলামে আছে, প্রতিশোধ ইসলামে অনুমোদিত। কিন্তু ন্যায়বিচারের স্বার্থে ব্যক্তি পর্যায়ে না হয়ে বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এটা ইসলামে অনুমোদিত, কিন্তু আল্লাহ্‌ বলেন, আপনি যদি এখনও সুন্দরভাবে ক্ষমা করতে ও সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পারেন, শুধু রাগ দমন নয়, ক্ষমা করতে পারেন, তবে কি পুরস্কার পাবেন? আমি কেন প্রতিশোধ নেব যখন আমার ক্ষমা করা উচিৎ? কেন আমি একটির পরিবর্তে অন্যটি নেব? তিনি বলেন, তার জন্য পুরস্কার… স্মরন করুন, আগে তিনি বলেছেন তার কাছে যা আছে তা উত্তম ও চিরস্থায়ী। এবার তিনি বলছেন আপনি যদি কাউকে ক্ষমা করতে চান, আপনার রাগ দমন করেন। এর পুরস্কার এত ব্যাপক যে এটা বর্ণনা করা সম্ভব না। শুধু এটাই বলা যায় যে তা আল্লাহ্‌র কাছে, আল্লাহ্‌ই আপনাকে দেখবেন। এর বর্ণনা এতই বিস্তৃত যে শুধু এটুকুই বলা যায়, আল্লাহ্‌র হেফাজতেই রয়েছে আপনার পুরস্কার। সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ্‌ আমাদের সবাইকে রাগ নিয়ন্ত্রন সহজ করে দিন, শান্ত থাকার তাওফিক দিন এবং বিশেষভাবে ক্ষমা করার যোগ্যতা দিন। নির্দিষ্টভাবে যখন পরিবারের সদস্যদের ভিতরে এটা ঘটে। কারন আমরা পরিবারের প্রতি খুব অসহিষ্ণু।

মতামত

comments