জিব্রাইল (আঃ) এর গল্প (৫ম পর্ব)

রাসূল ﷺ যখন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন জিব্রিল কিভাবে সান্ত্বনা দিতেন? রাসূল ﷺ যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তিনি বলেন, জিব্রিল আমার কাছে আসলেন এবং বললেন- ও মুহাম্মাদ! আপনি কি অসুস্থ? আমি বললাম – হ্যাঁ। তখন জিব্রিল তাঁর হাত দিয়ে আমার মুখমণ্ডল এবং বক্ষ মুছে দিলেন এবং বললেন- ‘বিসমিল্লাহি আরকিকা মিন কুল্লি শাইয়িন ইয়ুজিকা’। আল্লাহর নামে আমি আপনার জন্য আরোগ্য প্রার্থনা করছি সবকিছু থেকে যা আপনার ক্ষতি করছে – ”মিন সাররি কুল্লি নাফসিন আও আইনিন, আও হা-সিদ।” সকল খারাপ জিনিস থেকে অথবা বদ নজর থেকে বা হিংসা থেকে। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য দান করুন। আল্লাহর নামে আমি আপনার জন্য আরোগ্য প্রার্থনা করছি। কিন্তু তখন ব্যাপারটা কেমন ছিল যখন জিব্রিল (আঃ) রাসূল ﷺ কে জীবন সম্পর্কে কোন উপদেশ দিতেন! এখন আমি আপনাদেরকে যে বিষয়টি বলবো সেটি রাসূল ﷺ এর জীবনের শেষ দিককার। জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) রাসূল ﷺ এর নিকট এসে বললেনঃ হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আচ্ছা, আল্লাহ কি কুরআনে কখনও এভাবে বলেছেন ‘হে মুহাম্মাদ’? না। ইয়া নাবিয়াল্লাহ, ইয়া রাসূলাল্লাহ – ও আল্লাহর নবী, ও আল্লাহর রাসূল (এভাবে বলেছেন)। তাহলে জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) কি করে ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ বলার সাহস করলেন? আলেমরা বলেন যে, যখন জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) বলেন, ‘ইয়া মুহাম্মাদ’, এর মানে হলোঃ তিনি নবীﷺ কে এটা বুঝাতে চাচ্ছেন যে, এখনকার বিষয়টি ওহীর বাইরের বিষয়। যখন আমি আপনাকে ‘ইয়া মুহাম্মাদ’ বলি, তার মানে বিষয়টি আপনি মুহাম্মাদ আর আমার মধ্যকার। সুতরাং এটা হলো কেবল এমন একক সময় যখন জিব্রাইল ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলে সম্বোধন করলেন না। কারণ এখন আমি এমন কথা বলবো যা কেবল আপনার আর আমার মাঝে। বিষয়টি বুঝতে পারছেন আশা করি।

সুতরাং তিনি বলেনঃ হে মুহাম্মাদ, ৫টি উপদেশ দিচ্ছি আপনাকে।
১। আপনি যেভাবে খুশি জীবন যাপন করুন। কিন্তু একথা মনে রাখবেন যে আপনি একদিন মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছেন। একদিন আপনি মরবেনই।
২। তিনি আরো বলেন, আপনি যাকে খুশি ভালোবাসেন। কিন্তু মনে রাখবেন যে একদিন আপনি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।
৩। আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন। কিন্তু একথা স্মরণে রাখবেন যে, আপনার কর্ম অনুযায়ী আপনাকে প্রতিফল দেয়া হবে। প্রতিদান আখিরাতেই পাবেন।

এর মানে কি? মানে হলো, প্রত্যেকটি বিষয় আখিরাতে আসবে, প্রত্যেকটি পুরষ্কারই আখিরাতে দেওয়া হবে। আপনি যা করেন তা করতে থাকুন আর মনে রাখবেন যে এর বদলা আখিরাতে পাবেন।

৪। জেনে রাখুন, একজন বিশ্বাসীর জন্য সত্যিকারের আভিজাত্য রাত্রি বেলা নামাজে দাঁড়ানোর মাঝে।
৫। আর তার প্রকৃত মর্যাদা আত্মনির্ভরশীলতার মাঝে।

আর্থিকভাবে, আবেগের দিক থেকে, মানসিকভাবে বা শারীরিকভাবেই হোক, একজন মানুষ হিসেবে আপনার সম্মান ও মর্যাদা অন্য মানুষের উপর নির্ভর না হওয়ার প্রচেষ্টার মাঝে। যে কোন ব্যাপারেই হোক না কেন নিজেকে মানুষের প্রয়োজন থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।

এরপর রাসূল ﷺ জীবনের অন্তিম সময় অনুভব করতে থাকেন। আর যখন অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে… আবু সাইদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করে বলেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবাদের মাঝে অবস্থান করছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব সাধারণভাবে বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর এক বান্দাকে এ এখতিয়ার দিয়েছেন যে বান্দাহ হয় দুনিয়ার শান শওকত থেকে পছন্দ করবে অথবা যা কিছু আল্লাহর কাছে রয়েছে তা থেকে পছন্দ করতে পারবে। তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়িতে সবাই কাঁদছিল, কারণ সবাই জানতো যে রাসূল ﷺ এর অন্তিম সময় চলে এসেছে, তিনি শেষ সময়ের নিটকবর্তী হয়েছেন। বিশেষ করে ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) ভীষণভাবে বিধ্বস্ত হলেন।

তাঁর কন্যা, উম্মু আবিহা, তাঁর পিতার মা, (বাবারা নিজ কন্যাদের আদর করে মা বলে ডাকেন) সর্বদা তাঁর ﷺ সাথে ছিলেন ঐ সময়ে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার প্রতি ভালবাসা দেখালেন, মমতা দেখালেন। এমনকি যখন তিনি কোনোরকমভাবে কথাও বলতে পারছিলেন না, তখনও তিনি হাতের ইশারায় ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-কে ডাকলেন। ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) কাছে আসলেন, রাসূল ﷺ তাকে আরো নিকটে আসতে বললেন এবং চুপিসারে তার কানে কিছু বললেন। ফলে ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) আরো বেশি কাঁদতে লাগলেন। রাসূল ﷺ তাকে পুনরায় কাছে আসতে বললেন এবং চুপিসারে আরো কিছু কথা বললেন। এবার একথা শুনে ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হাসিতে ফেটে পড়লেন! আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এগুলো দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন যে একবার ফাতিমা কাঁদলো আবার হঠাৎ করেই হাসিতে ফেটে পড়লো! সুতরাং তিনি ফাতিমা কে চাপাচাপি করছিলেন যে- বলো না কি বলেছেন তিনি? বলছো না কেন?! কি বলেছেন তিনি? শেষে ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)জোরারোপের কারণে বলতে বাধ্য হলেন যে, তিনি বলেছেন, জিব্রীল সাধারণত প্রতি রামাদানে আমাকে নিয়ে পুরো কুরআন একবার ঝালিয়ে নেন। আর এই বছর রামাদানে তিনি দুইবার পুন:পাঠ করেছেন। তাঁর মানে হলো, জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) ওহীকে শক্তিশালী করে দিলেন। আর আমার মনে হয় না আমি আর রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারবো।

আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) রাসূল ﷺ – কে যেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন সেখানে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দৃঢ় হতে সাহায্য করেন আর এমতাবস্থায় রাসূল ﷺ তার শরীরে হেলান দিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি পড়লো আব্দুর রাহমান ইবনে আবু বাকার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এর ওপর, যিনি আয়েশার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এর ভাই। তিনি দেখলেন তার পকেটে একটি মিসওয়াক রয়েছে এবং আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন যে আমি বুঝতে পারছিলাম যে রাসূল ﷺ এটি পেতে চাচ্ছেন। আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) রাসূল ﷺ কে বললেন, আপনি মিসওয়াক চান? রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথা নাড়িয়ে স্বীকৃতি জানালেন। আব্দুর রাহমান তাঁর অব্যবহৃত মিসওয়াকটি আয়েশা(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) কে দিলেন। তিনি এটাকে চিবিয়ে নরম করলেন এবং রাসূল ﷺ এর মুখে পুরে দিলেন। এর সাংকেতিক অর্থ হলো, রাসূল ﷺ প্রত্যেক ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে মিসওয়াক করতেন। কারণ তিনি চাইতেন যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকালে যেন তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস বিশুদ্ধ থাকে, প্রতিদিনই ৫ বার। তিনি বললেন, তিনি এটিকে ফরজ করতে পারতেন, যদি উম্মাতের জন্য কষ্টকর না হতো। তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের পূর্বে প্রত্যেকবারই মিসওয়াক করতেন।

আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, যখন তিনি মিসওয়াক করা সমাপ্ত করলেন, তখনই জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) আমাদের মাঝে প্রবেশ করলেন। তিনি (আয়েশা) রাসূল এর দিকে তাকালেন আর দেখতে পেলেন তাঁর চেহারা আলোয় উদ্ভাসিত হলো। জিব্রীল (আলাইহিস সালাম); যিনি নবীকে ওপরের উপদেশগুলো দিয়েছিলেন, তিনি নবী ﷺ কে বললেন, শুনুন, আমি আপনাকে একটি বিষয়ে পছন্দ করতে বলবো। হয়তো আপনি আপনার সাহাবীদের সাথে থাকবেন এবং সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করবেন অথবা আপনি “সর্বোচ্চ” (আল-আ’লা); আল্লাহ এর সাহচর্যে থাকবেন। জিব্রীল (আলাইহিস সালাম) যখন এই কথাটি বললেন, তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার উত্তরে বললেন, ‘বালা, রাফিকিল আ’লা’, ‘আল্লাহুম্মা রাফিকিল আ’লা’- ওহ আল্লাহ, আমি সর্বোচ্চ (আল্লাহ) এর সাহচর্য কামনা করি। আয়িশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, যখন তিনি ‘আর রাফিকিল আ’লা’ বলছেন, তিনি যেন তাঁর সমস্ত শরীরকেই ছেড়ে দিচ্ছেন! ”ওহ আল্লাহ, আল্লাহর সাহচর্য!” বলতে বলতে তাঁর হাত পড়ে গেলো এবং নবী ﷺ মৃত্যুবরণ করলেন।

যখন এই ঘটনা হলো, আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) চিৎকার করে উঠলেন। ফাতিমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) যখন আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এর চিৎকার শুনতে পেলেন, তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইয়া আবাতা, মান রাব্বিহি মা আদনা’ – হে আমার পিতা, আপনি আপনার রবের কতটা সন্নিকটে আছেন এখন! হে আমার পিতা, আমরা জিব্রীলের (আলাইহিস সালাম) এর নিকট আপনার মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণা দিচ্ছি। ‘ইয়া আবাতা, জান্নাতুল ফিরদাউসি মা’ওয়া’ – হে আমার পিতা, জান্নাতই আপনার বর্তমান ঠিকানা! এবং একথাটিই তিনি বারবার বলতে থাকলেন, বলতেই থাকলেন, বলতেই থাকলেন। ”আপনি আপনার রবের কতটা নৈকট্যে আছেন, জিব্রীলের নিকট আপনার প্রস্থানের ঘোষণা দিচ্ছি এবং জান্নাতুল ফিরদাউস-ই আপনার আবাসস্থল।”

মতামত

comments