কুর’আনের ভাষাগত মু’জিযা (পর্ব ২) – ইয়াসরিব নাকি মদীনা?

কুর’আনের ভাষাগত মু’জিযা (পর্ব ২) – ইয়াসরিব নাকি মদীনা?

স্ক্রীনে দেখানো দুটো নামই আপনারা জানেন, ইয়াথরিব এবং মদীনা। দুটোই কি একই শহরের নাম? অবশ্যই।

কুরআন মদীনা শহরের কথা বলার সময় “মদীনা” শব্দটি বহুবার ব্যবহার করেছে। স্ক্রীনে আপনাদের জন্য অন্তত সেরকম তিনটি আয়াত দেখানো হয়েছে। কিন্তু কুরআন মাত্র একবার “ইয়াথরিব” শব্দটি ব্যবহার করেছে। শুধুমাত্র সুরা আহযাবে, ব্যস! কুরআনের অন্য কোথাও “ইয়াথরিব” শব্দটি ব্যবহার করা হয় নি। দুটোই কিন্তু মদীনারই নাম।

তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যেতে পারে, দুটোই তো একই জিনিস, তাই না? তাহলে আমি কেন ইয়াথরিব শব্দটি বদলে মদীনা লিখতে পারি না? অথবা মদীনার না বলে ইয়াথরিব বলি না? তোমরা বারবার বল, কুরআনের শব্দচয়ন পুরোপুরি পারফেক্ট। তোমরা তো জানই ইয়াথরিব আর মদীনা দুটোই একই জিনিস। তাহলে কেন ইয়াথরিবের বদলে মদীনা কিংবা মদীনার বদলে ইয়াথরিব ব্যবহার করা যাবে না? কতটুকুই আর হেরফের হবে তাতে? এই সামান্য পরিবর্তনে কি আসে যায়?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের ইতিহাসের দিকে একটু তাকাতে হবে। রাসুল (স) মদীনায় আসার আগে মদীনার নাম কি ছিল? ইয়াথরিব। রাসুল (স) আসার পর তাকে যখন সবাই একবাক্যে নেতা বলে ঘোষণা দিল, তখন শহরটার নাম হল “মদীনাতুন্নাবী” বা “নবীর (স) শহর”। সংক্ষেপে “শহর”। তাহলে মদীনা শব্দটি কিসের সংক্ষিপ্ত রূপ? “নবীর (স) শহর” শব্দটির। আর আসল নাম “ইয়াথরিব”। অথবা আপনারা এভাবেও ভাবতে পারেন যে, রাসুল (স) আসার আগে শহরটির নাম ছিল ইয়াথরিব, আর উনি আসার পর এর নাম হল মদীনা।

মজার ব্যাপার হল, সুরাতুল আহযাব, সুরা নম্বর ৩৩ এ আসলে মদীনা এবং ইয়াথরিব, দুটোই ব্যবহার করা হয়েছে, একই সুরাতে। আরও মজার ব্যাপার হল, সুরাতুল আহযাব একটি মাদানী সুরা। মাদানী সুরার ব্যাপারে আমরা কি জানি? রাসুল (স) সেসময় কোথায় ছিলেন? মদীনাতে। তাহলে তখন শহরটাকে কি বলা হত? মদীনা, কিন্তু এখানে আমরা “ইয়াথরিব” শব্দটি দেখতে পাচ্ছি। ধাঁধাঁটা ধরতে পারছেন তো? ব্যাপারটা হল, মদীনা শব্দটি “মদীনাতুন্নাবী” বা “নবীর (স) শহর” এর সংক্ষিপ্ত রূপ। যখন মদীনাকে শত্রুরা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলল, তখন কিছু ইহুদী গোত্র একসাথ হল।

তারা এসে উহুদ যুদ্ধের পরাজয়ের পর কুরাইশদের বোঝাল মদীনার দিকে দল বেঁধে আবার আসতে। তারা ছোট ছোট গোত্রগুলোর সাথে জোট বেঁধে বিশাল এক সেনাবাহিনী তৈরি করে মদীনাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। প্রায় সপ্তাখানেক ধরে মদীনা শহরকে একরকম বন্দী করে রাখা হল।
অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেল ভেতরে থাকা কিছু মানুষের জন্য, ভেতরে কিছু মানুষ ছিল যারা শুধু নামেই মুসলিম ছিল, কিন্তু তাদের হৃদয়ে ইসলাম ছিল না। তাদেরকে কি বলা হয়? মুনাফিক বা ভন্ড, তাই না?

রাসুল (স) আসার আগে মুনাফিকরা কোন শহরের নেতা ছিল? তারা ছিল ইয়াথরিবের নেতা। রাসুল (স) আসার পর তারা তাদের নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ স্বভাবতই মুসলিমদের নেতা কে? মুহাম্মদ (স)।

এখন যখন মদীনাকে কাফেররা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, তখন তারা এটার সুযোগ নিয়ে বলল, দেখ সবাই, মুহাম্মদের নেতৃত্ব আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছে। তাই তারা বলল, “ওয়া ক্বলু, ইয়া আহলা ইয়াথরিব লা মুক্বামা লাকুম”। মানে হল, “হে ইয়াথরিবের লোকজন, তোমাদের যাওয়ার আর কোন জায়গা বাকি নেই”। “ফারজি’য়ু” “চল আমরা ফিরে যাই”। কিসে ফিরে যাই? শহরটাকে আবার ইয়াথরিব করে ফেলি। রাসুল (স) নেতৃত্বে আসার আগে যেমনটা ছিল, ঠিক তেমনটায়।

আপনারা কি বুঝতে পারছেন যে “ইয়াথরিব” শব্দটা ব্যবহার করে তারা কি প্রকাশ করল? তাদের আসল আনুগত্য কাদের প্রতি। কারণ, যদি তারা রাসুল (স) কে তাদের নেতা বলে আসলেই মেনে নিত, তাহলে তারা কোন শব্দটা ব্যবহার করত? মদীনা। তাই, শুধুমাত্র এই একটা শব্দ ব্যবহার করে, আল্লাহ সেই শব্দটা ধরেছেন, কুরআনে সেটাকে প্রকাশ করেছেন এবং আমরা সেখান থেকে তাদের আসল উদ্দেশ্য কি সেটা বুঝতে পারি, যেটা হল, “একদিন শহরটা আবার ইয়াথরিব হয়ে যাবে, মদীনা আর থাকবে না।”

এই ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট আর পরিষ্কার হয়, যখন আমরা অন্য আরেকটি সুরায় যাই। সুরাতুল মুনাফিকুন, যে সুরাতে কাদের কথা বলা হয়েছে? মুনাফিকদের, ভন্ডদের। মুনাফিকদের নিয়ে সুরাটা অনেক ইন্টারেস্টিং। সুরাটা শুরু হয়েছে মুনাফিকদের রাসুল (স) এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা দিয়ে। মুনাফিকরা তাদের স্বভাব থেকে সরে গিয়ে রাসুল (স) এর প্রতিদ আনুগত্য দেখানোর জন্য বলত, “ইযা যাকাল মুনাফিকুন কালু নাশশাহাদা ইন্না কালা রাসূলুল্লাহ” – “মুনাফিকরা যখন আপনার কাছে আসে, তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, কোন সন্দেহ নেই আপনিই নিশ্চিত ভাবে আল্লাহর রাসুল”।

মুসলমানদের রাসুল (স) কে প্রতিবার এটা বলতে হত না, শুধুমাত্র মুসলমান হবার সময় বললেই হত, তাই না? যখন সে ইসলাম গ্রহণ করে শুধু তখন সেটা বলা দরকার। আর বাকী সময়গুলোতে দরকার নেই কারণ, সে জানে যে তিনি আল্লাহর রাসুল।

কিন্তু আপনি যদি সেটা না ভেবে আপনার মনে অন্য কিছু থাকে, তখন আপনি সেটাকে পূরণ করা চেষ্টা করবেন, ঠিক একটা বাচ্চা যেভাবে বলে, আমি কিন্তু করি নি। আর শুনে আপনি বলেন, তুমি কি কর নি? এটা আসলে অপরাধবোধ থেকে বলা। তাদের অপরাধী বিবেক তাদেরকে বারবার বলতে বাধ্য করে, “আমরা আসলেই বিশ্বাস করি যে আপনি আল্লাহর রাসুল।” এই সুরাতে তারা বাইরে বাইরে রাসুল (স) এর প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য বলেছে, “লা ইররাযানা ইলাল মাদিনাহ লা ইয়ুখরি জান্নাহ আজ্জু মিনাল আজাল” – “তারা বলেছে, আমরা যখন “মদীনা”তে ফিরে যাব।” কারণ তারা তাদের আনুগত্য দেখানোর চেষ্টা করছিল।

কিন্তু সুরাতুল আহযাবে যখন রাসুল (স) এর বিপদের সময় আসল, তাদের মুখ থেকে ভুল শব্দটা বেরিয়ে আসল, আর তাদের আসল আনুগত্য কাদের প্রতি, সেটা প্রকাশ পেয়ে গেল।

মতামত

comments